জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত আমাদের অপেক্ষা বেঁচে থাকে
>চলে গেলেন বলিউডের শক্তিমান অভিনেতা ইরফান খান। গতকাল ২৯ এপ্রিল ভারতের মুম্বাইয়ে মারা যান তিনি। ২০১৭ সালে কলকাতায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আদর রহমান। ইরফান খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই সাক্ষাৎকারের অপ্রকাশিত অংশ এখানে ছাপা হলো।
ইরফান খান কথা দিয়েছিলেন, আবার কথা হবে, দেখা হবে। কারণ আরো কিছু বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছা ছিল তাঁর। নিজের বাংলাটাকে আরও একটু পোক্ত করে বাংলাদেশের দশর্কদের সামনে আসতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'তোমার দেশের দশর্কেরা আমাকে ভাঙাচোড়া বাংলা বলার জন্য ক্ষমা করলে একটু সাহস পাব। তখন আবার বাংলা ছবিতে অভিনয় করব।' ইরফান তাঁর কথা রাখতে পারলেন না। ক্যানসারের কাছে হার মেনে চলে গেলেন। বাংলা ভাষাটা কতটা আয়ত্তে আনতে পেরেছিলেন, সেটাও আর জানা হলো না।
ইরফান খান নাকি খুব রাশভারী মানুষ- এমনটা অনেককেই বলতে শুনেছিলাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে দুদিন দেখা হয়েছে, গাম্ভীর্যের লেশমাত্র ছিল না। ২০১৭ সালের অক্টোবরে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত 'ডুব' ছবির জের ধরে ইরফান খানের সঙ্গে ভারতের কলকাতায় দেখা হয়েছিল। পাঁচ তারকা হোটেলের এক রেস্তোরাঁয় বসে সাক্ষাৎকারের দেন তিনি।
'ডুব' ছবি নিয়ে লম্বা আলাপের পরও কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ইরফান। আলাপ আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য আমরা বলে রাখলাম-
আবার কবে দেখা হয় আপনার সঙ্গে ঠিক নেই, তাই আজ একটু বেশিই প্রশ্ন করে রাখি। আপনার অভিনয়জীবন তো তিন দশকের, তাই না?
ইরফান: না না, আমার অভিনয়ের শুরু ১৯৯৫ সালে। মানুষ কেন যে তিন দশক বলে বুঝি না।
আচ্ছা, তাহলে এই দুই দশকের অভিনয়জীবন নিয়েই বলুন, সবচেয়ে সেরা আর সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অংশ কোনটি?
ইরফান: এই জীবনের সবচেয়ে সেরা দিক হলো, নিজেকে প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কার করা যায়। নিজের এই আবিষ্কারকে, অভিজ্ঞতাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা যায়। আর অনাকাঙ্ক্ষিত দিক হলো, মনের অজান্তেই খ্যাতির নেশা মাথায় চেপে বসতে পারে। তখন মানুষ তাঁর নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের চেয়ে মানুষের মন্তব্য আর প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে, সেটাই তাঁর মেধায়, তাঁর শিল্পে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সেটাই হয়ে ওঠে একজন অভিনেতার জন্য ক্ষতিকর।
একটা সময় ছিল যখন আপনি স্ক্রিপ্টের (চিত্রনাট্য) জন্য অপেক্ষা করতেন। ভালো গল্পের জন্য তৃষ্ণার্ত থাকতেন। এখন তো আর সেই অপেক্ষা নেই। ভালো গল্পের জন্য সেই তৃষ্ণাটা কি এখনও আছে?
ইরফান: স্ক্রিপ্ট তো এখন অনেকই আসে। কিন্তু আমি যে ধরনের স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে চাই, তেমন স্ক্রিপ্ট পাওয়ার তৃষ্ণা আমার কখনো কাটে না। আমার অপেক্ষায় থাকার অভ্যাসটা যায়নি। আমি এখনো একটা ভালো গল্পের জন্য অপেক্ষা করি। ভালো গল্পের জন্য একজন অভিনেতার অপেক্ষা কখনো ফুরায় না। এই তৃষ্ণা কখনোই মেটে না। জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত আমাদের অপেক্ষা বেঁচে থাকে।
১৯৯৫ সালে যখন অভিনয়ে আসেন, তখন তো শাহরুখ, আমির, সালমান খানের মতো সুদশর্ন, সুঠাম নায়কদের দাপটের শুরু হয়। সে সময় ভেবেছিলেন আপনি নায়ক হিসেবে বলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন?
ইরফান: আমি কখনো নিজেকে কারো সঙ্গে তুলনা করি না। আমি মনে করি, মেধা থাকলে নিজের জায়গা তৈরি করে নেওয়া যায়। বিষয়টা ক্রিকেটের মতো। যদি দলে দুই জন বোলার, দুই জন ব্যাটসম্যান থাকে, এর মানে এই নয় যে দলে তৃতীয় একজন বোলার বা ব্যাটসম্যানের প্রয়োজন নেই। তোমার অবস্থান নিভর্র করে তোমার পারফর্মেন্সের ওপর। তুমি কিভাবে খেলব, তুমি কিভাবে গল্প বলবে, এর পর ওপর নিভর্র করবে তোমার টিকে থাকা।
আপনার প্রথম চাকরি কী ছিল?
ইরফান: আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের পড়াতাম। তখন আমি কলেজে পড়ি। কলেজে যাওয়ার জন্য একটা সাইকেলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই একটা সাইকেল কেনার জন্য বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করি।
কলেজের পর আপনি এনএসডিতে (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পান। অভিনয় নিয়ে পড়ার শুরু হয় সেখান থেকে। পরিবার থেকে সম্মতি ছিল?
ইরফান: কেউ খুশি ছিল না আমার সিদ্ধান্তে। সবাই ভেবেছিল, অভিনয় করা আর বেকার থাকা সমান। কিন্তু আমি ঠিকই পড়াশোনা চালিয়ে যাই। এনএসডিতে আমার একজন বাংলাদেশি সহপাঠী ছিল। ওর নামটা সুযোগ থাকলে লিখবেন। ওর নাম ইমদাদুর রহমান। আমি এনএসডিতে আমার প্রথম ডিপ্লোমা প্রডাকশনের কাজটা ওর সঙ্গে করি। এর নির্দেশনায় অভিনয় করি হেরাল্ড পিন্টারের বিখ্যাত নাটক 'দ্য ডাম্ব ওয়েটার'-এ। এই প্রডাকশনের জন্য ইমদাদ সেরা নির্মাতার পুরস্কার পায়।
কোন অভিনেতাদের অভিনয় দেখে এই জগতে আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
ইরফান: দীলিপ কুমার, মারলন ব্র্যান্ডো, নাসিরুদ্দীন শাহ্।
আর এ সময়ে কাদের অভিনয় দেখে অনুপ্রেরণা পান?
ইরফান: অনেকেই আছেন। তবে একজনের কথা বিশেষ করে বলতে চাই। জোয়াকিম ফিনিক্সের অভিনয় আমার খুবই ভালো লাগে।
শেষ প্রশ্ন, কোনো বাংলা ছবি বা বাঙালি নির্মাতার কাজ কী আপনাকে অনুপ্রেরণা দেয়? প্রভাবিত করে?
ইরফান: বাংলা ছবির কথা বলতে পারব না। তবে বাঙালি নির্মাতাদের কাজ আমাকে প্রভাবিত করে। ঋতিক ঘটকের কাজের ভক্ত আমি, তাঁর জীবন, দর্শন, কাজই আমাকে প্রভাবিত করে। আর এ সময়ের মধ্যে বাঙালি নির্মাতা সুজিত সরকারকেও আমি অনুসরণ করি। আমি কবিতা পড়তে পছন্দ করি। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাও আমাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করে।
পেছন থেকে এসে ইরফান খানের ব্যবস্থাপক আমাদের আলাপ শেষ করার তাড়া দেন। ইরফান উঠে দাঁড়ান। আমরা ছবি তুলি। বিদায় নিই। ইরফান বলেন, 'আবার দেখা হবে।' সেটা আর হলো কই!