জাতীয় আঙ্গিকে আন্তর্জাতিক প্রযোজনা
ম্যাকবেথ শেক্সপিয়ারের একটি ফরমায়েশি নাটক। ডেনমার্কের রাজা ইংল্যান্ডে বেড়াতে আসবেন। তাঁর সম্মানে একটি নাট্যাভিনয় হবে। শেক্সপিয়ার একটি নাটক লিখবেন। শেক্সপিয়ার গেলেন ডেনমার্ক দূতাবাসে। জানতে চাইলেন রাজার প্রিয় বিষয় কী। দূতাবাস খোঁজখবর নিয়ে জানাল ভূত-পেতনি। শেক্সপিয়ারের একটা ঝোঁক লোককাহিনিতে। পেতনি দিয়ে শুরু করলেন ম্যাকবেথ নাটক এবং প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, রক্তপাত, যুদ্ধ—এসব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল নাটক ম্যাকবেথ। ডেনমার্কের রাজা নাটকটি দেখে কতটা তুষ্ট হয়েছিলেন, তা আর জানা যায়নি। তবে বিশ্ববাসী চার শ বছর ধরে ম্যাকবেথ দেখে আসছে নানা আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথ ৯ বছর বয়সে ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন।
রতন থিয়াম সম্প্রতি ঢাকার মঞ্চে ম্যাকবেথ করে গেলেন একেবারেই তাঁর মণিপুরের লোক-আঙ্গিকে। ভাষা বুঝতে পারিনি কিন্তু তাতে নাটক বুঝতে কোনো কষ্ট হয়নি। অত্যন্ত নিখুঁত দেহভঙ্গিমায় অভিব্যক্তিগুলো যেমন ফুটে উঠেছিল, তাতে ভাষা না বুঝলে কোনো কিছু যায়-আসে না। রতন থিয়ামের নাটক দেখি আজ থেকে ৪০ বছর আগে কলকাতায় নান্দিকার নাট্যমেলায়। মহাভারতের ‘চক্রব্যূহ’ পর্বটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কী চমৎকার দেহের ভাষা ও মার্শাল আর্ট তিনি নির্মাণ করেছিলেন। নাটক শেষে একজন দর্শক বলে উঠলেন, এটা কি নাটক হলো? মঞ্চ থেকে তখন রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত ক্ষুব্ধ হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, নাটক আর কীভাবে হয়, জানি না। আমরাও এই অর্বাচীনসুলভ প্রশ্নে বিব্রত হয়েছি। এরপর রতন থিয়ামের বেশ কিছু নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। নাটকে তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দৃশ্যসৌন্দর্য নির্মাণ করেন। সে নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনাও আছে। কিন্তু ম্যাকবেথ-এ এসে সেসব কমে গিয়ে বিষয়বস্তুর প্রতি নিবিড় আন্তরিকতা লক্ষ করা যায়।
আঙ্গিক এখানে মণিপুরি কিন্তু বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক। এর মধ্যে কিছু সমসাময়িক বিষয়, যেমন ম্যাকবেথের আকস্মিক হাসপাতালে হুইলচেয়ারে আগমন। সেবিকাদের প্রতিক্রিয়া অথবা শেষ দৃশ্যের আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ইতিহাসের জঞ্জাল পরিষ্কার করার অভিযান, পরীক্ষা করার অভিযান—এসব অর্থবহ হলেও মূল কাঠামোর সঙ্গে যায়নি। কিন্তু এসব নিরীক্ষা তাঁর প্রযোজনায় থাকেই।
মণিপুরের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার নৃত্যগীত ও যন্ত্রসংগীত। এমন সব যন্ত্র তাদের আছে যে সেসব যন্ত্র মানুষের মতোই নানা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। নাটকের প্রয়োজনে আমরাও কখনো নিজেরাই নতুন যন্ত্র তৈরি করে থাকি। সেই সব যন্ত্র অভিনয়কে অনেক বেশি অর্থবহ করে তোলে। ম্যাকবেথ, লেডি ম্যাকবেথ, সেনাবাহিনী—সবার কোরিওগ্রাফি ভীষণভাবে যন্ত্রের সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু এখানে ম্যাকবেথের স্বগত সংলাপ চলছে বা লেডি ম্যাকবেথের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটছে, তখন সংগীত একটু ধীরলয়ে চলে যায় কিন্তু আলো-ছায়ার একটা অদ্ভুত কালো-লালচে আঁধার তৈরি হয়। সেই আলোর উৎস আবার প্রায়শই ওপরে বাঁধা। আলো ওপরে ও পাশে থেকে দেওয়াতে অভিব্যক্তিগুলো একটা অন্য ব্যঞ্জনা পেয়েছে। ম্যাকবেথের বা লেডি ম্যাকবেথের রক্ত নিয়ে যে খেলা, তার মধ্য থেকে আলোক নির্দেশক রতন থিয়াম-পুত্র থাউয়াই থিয়াম এক নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। ধন্য রতন-পুত্র থাউয়াই থিয়াম। অন্ধকারের মধ্যেও কণ্ঠস্বর ও সংগীত মিলে যে একটা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়, তা-ও অভিনব। রতন থিয়ামের প্রযোজনায় একেবারেই নতুন মার্শাল আর্টের নতুনত্ব আমাদের মুগ্ধ করে বরাবরই। এখানেও কস্টিউম ও অস্ত্রশস্ত্রের ডিজাইন মনোমুগ্ধকর। ম্যাকবেথ অনেকভাবে মঞ্চে ও সিনেমায় দেখার আমাদের সুযোগ হয়েছে কিন্তু এবার নতুন একটি চিত্রকল্প নির্মাণে ম্যাকবেথ যথার্থই সহায়ক। এখানে এ-ও শিক্ষণীয় যে জাতীয় আঙ্গিক ও ভাষাকে যদি আত্মস্থ করা যায়, তাহলে তরুণ নাট্যকার, নির্দেশকেরা যেকোনো বিষয়কে আন্তর্জাতিক করে তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশের কোনো একটি অঞ্চলের কাহিনি এবং কথ্য ভাষাকে যদি জাতীয় আঙ্গিকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করা যায়, তাহলে যেকোনো ভাষাভাষীর মানুষের কাছে তা অবলীলায় পৌঁছে যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রতন থিয়ামের ম্যাকবেথ অভিনয় এক প্রয়োজনীয় আয়োজন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব