চেনা রোমিও-জুলিয়েটের অচেনা অনাবিষ্কৃত পাঠ
>নতুন একটি দল আর নতুন নাটকের দেখা মিলল এ সপ্তাহে। নাটকের গল্প, সংলাপ, মঞ্চের আলোকসজ্জা, সাজপোশাক—সব মিলিয়ে ঢাকার মঞ্চে নতুন কিছুর আভাস দিল নাটকটি। নতুন এই দল এবং নাটকের খোঁজ নিয়েছেন মাসুম আলী
শেষ দৃশ্যটির কথা না বললেই নয়। চোখে ভাসছে, মনে গেঁথে গেছে। সংলাপগুলো গভীর। তখন নাটকের শিল্পীরা সবাই মঞ্চে। কবি, ফাদার ফ্রায়ার ও শেক্সপিয়ারের কথোপকথন। এক পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন জুলিয়েট ও রোমিও। জুলিয়েট ও রোমিওর কোনো সংলাপ নেই, কিন্তু তারা একপলকের জন্যও নাটক থেকে সরেননি।
‘এম্পটি স্পেস’ মঞ্চনাটকের একটি নতুন দল। রোববার সন্ধ্যায় দর্শকের সামনে এল দলটি। সেদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় দলটির প্রথম নাটক আ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। পরদিন সোমবার হয় নাটকটির দ্বিতীয় প্রদর্শনী। সাইমন জাকারিয়ার লেখা নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন নূর জামান।
নাটকের গল্প
১ ঘণ্টা ৫ মিনিটের নাটক। পুরো সময়টা দর্শকদের চোখ মঞ্চেই আটকে থাকে। বোঝা যায় মনোযোগ দিয়েই তাঁরা দেখছেন নাটক। কারণও আছে। সংলাপ, অভিনয়, আলো আর নেপথ্যের সংগীত দর্শকদের টানে। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন কবি, যিনি পূর্ণিমা রাতে সমাধিতে ফোটা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হন, গেয়ে ওঠেন গান। সে রকম এক রাতে তার গানে রোমিও আর জুলিয়েট এসে হাজির হন। কবি জুলিয়েটকে জানিয়ে দেন, রোমিও আসলে জুলিয়েটের আগে ভালোবাসতেন রোজালিনকে। তাকে দেখার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে রাতের এক ভোজসভায় যান তিনি। সেখানেই জুলিয়েটের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমিও ভুলে যান রোজালিনকে। প্রেম হয় রোমিও–জুলিয়েটের। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তারা। সাহায্য চান ফাদার ফ্রায়ারের। ফাদার গোপনে রোমিও-জুলিয়েটের বিয়ে দিয়েছিলেন। সত্য প্রকাশ না করে তিনি আবার প্যারিসের সঙ্গে জুলিয়েটের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। নিজের এ গোপন কর্মকে আড়াল করতে জুলিয়েটকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছিলেন ফাদার। কবি সেটাও মনে করিয়ে দেন। কবির এসব কাণ্ডে ফাদার আহ্বান জানান উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে। কবি শেক্সপিয়ারকেও ছাড়েননি। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে শেক্সপিয়ারের দ্য ট্র্যাজেডি অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের গঠন ভেঙে দেন।
পেছনের মানুষদের কথা
এই নাটকের গল্প, সংলাপ, মঞ্চের আলো, সজ্জা, সাজপোশাক ঢাকার মঞ্চে বেশ ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। নাটকটিকে দলের প্রথম প্রযোজনা হিসেবে বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে এম্পটি স্পেসের সভাপতি গোলাম শাহরিয়ার বলেন, ‘অনেক দিন থেকেই আমরা একটি নতুন চিন্তা ও দর্শনের নাটক খুঁজছিলাম। যেহেতু আমাদের দলটি তারুণ্যনির্ভর, তাই আমাদের কাছ থেকে নতুন চিন্তারই কিছু আশা করবে সবাই। আর সে সময়ই নাট্যকার ও গবেষক সাইমন জাকারিয়ার এই পাণ্ডুলিপি আমরা হাতে পাই।’
দেখা হলো নাট্যকার সাইমন জাকারিয়ার সঙ্গে। সফল মঞ্চায়ন শেষে সাজঘরে শিল্পী ও অতিথিদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন, ছবি তুলছিলেন। তিনি বললেন, ‘দর্শকের চিন্তাকে নতুনভাবে উসকে দিতে এবং চেনাজানা বিষয়ের অচেনা ও অনাবিষ্কৃত পাঠ নির্মাণ করতে দুই যুগ আগে এই নাটকটি লিখি। এর প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আমাদের জীবন, সময় ও প্রকৃতি জড়িত। আমার বিবেচনায় এই নাটকের চরিত্রগুলো এখনো বর্তমান। তারা প্রকাশ্যে বলেন এক কিন্তু গোপনে করেন আরেক। যেমন রোমিওর কথা ধরা যাক। তার ধ্যান-জ্ঞানে ছিলেন রোজালিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি রোজালিনের থেকে মুখ ফিরিয়ে জুলিয়েটের প্রেমে মেতে ওঠেন; জুলিয়েট জানতেও পারেন না হঠাৎ তিনি যে পুরুষের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছেন, সে পুরুষ তাকে ভালোবাসতে ভোজসভায় আসেননি, তিনি এসেছিলেন রোজালিনকে ভালোবেসে।’
নাট্যকারের মতে, অা নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকটি রচনার প্রায় দুই যুগ অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু ঢাকার কোনো নাট্যসংগঠন নাটকটি মঞ্চায়ন করার সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। এই নাটকের চিন্তাটি নতুন ও অভিনব। হয়তো সে কারণেই এত দিনে এই নাটকের চিন্তাকে ঢাকার প্রতিষ্ঠিত কোনো নাট্যসংগঠন গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। নতুন চিন্তার এই নাটক শেষ পর্যন্ত ঢাকার মঞ্চে প্রথমবারের মতো উপস্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে এম্পটি স্পেস।
শিল্পীবৃত্তান্ত
নাটকে কবি চরিত্রে অভিনয় করছেন গোলাম শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘আমি আর এ নাটকের নির্দেশক নূর জামান ১৪ বছর থিয়েটারে (বেইলি রোড) কাজ করেছি। এ বছরের প্রথম দিকে আমরা দল থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা যেভাবে চাচ্ছিলাম, দলে সেভাবে কাজ করতে পারছিলাম না। এ কারণে দলের সঙ্গে কথা বলেই বেরিয়ে আসি। এরপর একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়েকে সংগ্রহ করে নাটক শুরু করি।’
নাটকে রোমিও চরিত্রে অভিনয় করছেন নাটকের নির্দেশক নিজে। আর জুলিয়েটের চরিত্রে আছেন লোবা আহমেদ। এটিই তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন মডেলিং ও টেলিভিশনে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। শুধু লোবা নন, নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ নাটকের টানে সম্পৃক্ত হয়েছেন এ দলের সঙ্গে। যেমন প্রকৌশলী ফকির বিপ্লব, বিদ্যুৎ বিভাগের একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। নাটকটিতে ফাদার ফ্রায়ারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্বাধীন বিশ্বাস। তিনি স্বাস্থ্য ও কারিগরিবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্যোক্তা। শত ব্যস্ততা উপেক্ষা করে ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছেন থিয়েটারে।
ফেসবুকে যা চলছে
নাটক শেষে বাসায় ফিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মিলল অা নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নিয়ে নানান ছবি, মন্তব্য। শাহাদাত হোসেন লিখেছেন, ‘ঢাকার মঞ্চে অনেক নাটক আমি দেখি না শুধু পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার-লিফলেটের ডিজাইনের কারণে। এগুলো দেখেই প্রোডাকশনটির ডিজাইনগত ধারণা কিংবা রুচির প্রকাশ একটু হলেও পাওয়া যায়, ধারণাটি একেবারেই আমার নিজস্ব, যা অনেকের সঙ্গে হয়তোবা মিলবে না। আমি বলছি না এসব পছন্দ না হওয়া মানে কোনো নাটক উপস্থাপনের অযোগ্য। এম্পটি স্পেস থিয়েটারের অা নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট প্রযোজনাটি আমার ভালো লেগেছে। বিশেষ করে গল্প, সেট, মিউজিক আর কস্টিউম ডিজাইন এককথায় অসাধারণ।’
দর্শকের ভালো লাগাটাই তো নাটকের প্রথম সার্থকতা। অভিনন্দন এম্পটি স্পেস।