এখন গ্রামই নাঈমের ধ্যান-জ্ঞান
ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর নাঈম। বাবার সঙ্গে যেতেন আহসান মঞ্জিলে। আগেই জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে নবাবের বাড়ি। পুরান ঢাকায় যাতায়াত ছিল তাঁর, ছিল না আবাস। নাঈম বেড়ে উঠেছেন শাহবাগে। ছেলেবেলা কেটেছে মগবাজার এলাকায়। তাঁর মা টাঙ্গাইলের করটিয়া জমিদার বাড়ির মেয়ে। বাবা বাড়ি করেছিলেন দেলদুয়ারের পাতরাইলে। সেখানে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত সব শাড়ির কারখানা। নানাবাড়ি আর বাবার বাড়িতে ছেলেবেলায় যেতেন নাঈম। তখন থেকেই গ্রামের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্কের বয়স ৪০ বছরের কম নয়।
’৯৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর আরও বেশি গ্রামমুখী হয়ে ওঠেন নাঈম। সিনেমা ছাড়ার পর গ্রামই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। তাঁর এখনকার জগৎজুড়ে অনেকটাই পাতরাইল। গ্রামে তাঁর পুকুর আছে। পুকুরে মাছ চাষ করেন। আছে আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের বাগান। আছে পশুর খামার। কৃষিজমিতে চাষাবাদও করেন। সবকিছুই পুরোপুরি বাণিজ্যিক। আর আছে তাঁতের কারখানা। মাসে সপ্তাহখানেক সেখানেই কাটাতে হয় তাঁকে। জড়িয়ে গেছেন গ্রামের মানুষের সুঃখ-দুঃখের সঙ্গে।
করোনাকালে গ্রামের যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন নাঈম। রোগীদের কীভাবে ঢাকায় আনা যায় কিংবা ওখানে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়, এসব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। গ্রামের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা মায়া-মমতায় মিশে অন্য এক রূপ ধারণ করেছে। গ্রামে একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে প্রতিবছরের জানুয়ারিতে মাসব্যাপী ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয়। সেই আসরে ঢাকা থেকে রিয়াজ-ফেরদৌসরা যান। সেলিব্রিটিদের হাজিরায় অন্য মাত্রা লাভ করে গ্রামীণ ক্রিকেট।
এ রকম আরও সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাজে জড়িয়ে আছেন নাঈম। গ্রামের মানুষের সঙ্গে জীবন বাঁধলেও রাজনীতিতে আসার পরিকল্পনা নেই নাঈমের। কখনো ভাবেনওনি রাজনীতি নিয়ে। সবার ডাকেই সাড়া দেন নাঈম। তবে একটা প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানোর ইচ্ছা ভবিষ্যতে আছে। তাঁর সেবামূলক কাজগুলো যেন ছন্দ না হারায় ভবিষ্যতে, তার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ার ইচ্ছা হৃদয়ে পুষে রেখেছেন। গ্রামের মানুষ শহরের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ জন্য তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করেন নাঈম।
নিজে শুধু নন, স্ত্রী শাবনাজ ও দুই মেয়েকেও তিনি গ্রামে নিয়ে যান। বড় মেয়ে নামিরা নাঈম এখন কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। এনভায়রনমেন্ট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজিতে গ্র্যাজুয়েশন করছেন নামিরা। সেখানে নাঈম ও শাবনাজের অনেক আত্মীয়স্বজন আছেন। পারিবারিক পরিবেশেই প্রবাসজীবন কাটছে তাঁর। ছোট মেয়ে মাহদিয়া নাঈম এ লেভেল সমমানের পরীক্ষা দিয়েছেন আগা খান একাডেমি থেকে। তাঁর গানের সঙ্গে দর্শক-শ্রোতাদের পরিচয় হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বছর দুয়েক আগে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল তাঁর গান। গানটা মাহদিয়া শখের বশে করেন। গানটাকে সিরিয়াসলিও নিতে পারেন কখনো।
এখন দুই মেয়েরই প্রাধান্য পড়াশোনা। পড়াশোনায় দুজনেই মেধার পরিচয় দিয়েছেন।
নাঈম বলেন, মাহদিয়া গানের জন্য সময় বের করে মাঝেমধ্যে। বেশ কিছু গান করা আছে তার। করোনার জন্য গানগুলো রিলিজ দিচ্ছে না। নামিরার শখ পেইন্টিংয়ের দিকে। পড়াশোনার চাপের জন্য আপাতত ওদিকে বেশি ঝুঁকতে পারছে না। ব্যবসার বাইরে পরিবারকেই সময় দেন নাঈম। কিন্তু তাঁর একসময়ের আরেক পরিবার সিনেমা।
নাঈম জানান, তিনি যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গেই যোগাযোগটা ধরে রাখা গেছে। এঁদের মধ্যে অনেকে না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। এহ্তেশাম, মুস্তাফিজ, শিবলী সাদিকরা চলে গেছেন। আজিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। রিয়াজ ফোন করেন। ওমর সানী খোঁজ নেন। অমিত হাসানও খবর রাখেন। কিছুদিন আগে রোজিনা আপার বাসায় বেড়িয়ে এসেছেন নাঈম। নাটকের অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ আফসানা মিমির সঙ্গে। ‘দিল’ ছবিতে যাঁরা কাজ করেছেন, কিছুদিন আগে তাঁরা একত্র হন। শবনম, মিমি আর নাঈম-শাবনাজ মিলে পুরোনো দিনের গল্পে–আড্ডায় মেতে ওঠেন।
তবে এফডিসিতে যাওয়া হয় না। করা হয় না শুটিং। সাংগঠনিক কোনো উৎসব থাকলে যাওয়া হয়। তাঁদের পেলে সিনেমার মানুষেরা খুশিতে নেচে ওঠেন। নাঈম-শাবনাজ অল্পসংখ্যক ছবিতে অভিনয় করেছেন। অথচ এ ছবিগুলোর জনপ্রিয়তা বিপুল। তাঁদের ছবির কথা ঘুরেফিরেই আড্ডা-আলোচনায় আসে। অমন ছবি এখন হচ্ছে না বলে আফসোস শোনা যায় লোকের মুখে। কী সেই রহস্য, যার জন্য ছবিগুলোর আজও এত কদর!
মুখ খোলেন নাঈম, ‘আসলে আমি কোয়ান্টিটি থেকে কোয়ালিটিতে বেশি বিশ্বাস করতাম। বছরে ১০–২০টি ছবি করে তো লাভ হচ্ছে না। আমার যখন একটা ছবি হিট হয়ে যায়, তখন একের পর এক ছবির অফার আসে। প্রচুর ছবি রিফিউজ করেছি। আমি চিন্তা করে দেখেছি, বছরে চার–পাঁচটার বেশি ছবি করা ঠিক হবে না। গণহারে ছবি করে শুধু স্ক্রিনে আমি থাকব, এর কোনো মানে হয় না।
আমি যখন আসি, তখন সিনিয়ররা ছিলেন। নতুনেরা তেমন আসেনি। তারা আসে একটু পরে। অত ছবি করিনি আমি। তারপরও যে দর্শকেরা এখনো মন থেকে ভালোবাসার জায়গাটা আমাকে দিয়েছেন, তার জন্য আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। ১০০ ছবি করেও অনেকে এই জায়গাটা হয়তো পাননি। এর আনন্দ আলাদা, তৃপ্তি অনেক বেশি। অনেক বড় বড় ছবি, বেশি ছবি করেও অনেকে দর্শকদের হৃদয়ে থাকতে পারেননি।’
এ জন্য তখনকার সময়কে কৃতিত্ব দেন নাঈম। ‘দর্শক নতুনদের দেখতে চাচ্ছিলেন। আমরা একটা রোমান্টিক ছবি করলাম। দর্শকেরা লুফে নিলেন। মানুষ একটা জিনিস দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরিবর্তনটা ওভাবেই এসেছিল। আমরা যখন ছবি করেছি ডিশ কেব্ল ছিল না। এক বিটিভি ছিল। মানুষের বিনোদন ছিল টিভিতে নাটক আর সিনেমা হলের ছবি। বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম ছিল না। পরে বিভিন্ন দেশের সিনেমা ঢুকে গেল। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি অনেক পিছিয়ে গেল।’
সিনেমা ছেড়েছেন দুই দশক আগে। এখনো নাঈম-শাবনাজ জুটি নিয়ে চর্চা হয়। প্রশ্ন ওঠে এখনকার জুটিদের জনপ্রিয়তা নিয়ে। কীভাবে কালজয়ী জুটি হয়ে উঠেছিলেন নাঈম-শাবনাজ? ‘জুটি মানেই নাঈম-শাবনাজ বললে ভুল হবে। আমাদের আগেও জুটি ছিল। শাবানা–আলমগীর ছিলেন। রাজ্জাক-কবরী ছিলেন। কিংবদন্তি জুটি ছিলেন তাঁরা। তাঁদের পরে বলতে বললে হয়তো আমাদের কথা আসবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমাদের জুটির কথা আসতে পারে।
জুটি তৈরির পেছনে কেমিস্ট্রিটা ঠিক আছে কি না, দেখতে হবে। নায়ক ও নায়িকার বোঝাপড়াটা ঠিক আছে কি না, নায়কের ডায়ালগের জবাবটা কী দিচ্ছে নায়িকা, সংলাপ না থাকলে এক্সপ্রেশনটা কী দিচ্ছে, এগুলোকেই কিন্তু কেমিস্ট্রি বলে। সেই কেমিস্ট্রি যদি সুন্দর হয়, দর্শকদের কাছে ভালো লাগে, দর্শকই নায়ক-নায়িকাকে জুটিতে পরিণত করে ফেলেন।’
তখনকার কাজের পরিবেশ নিয়ে নাঈম স্মৃতিকাতর। বলেন, ‘আমরা গল্প নিয়ে বসতাম। চরিত্র নিয়ে বসতাম। গান রেকর্ডিংয়ে যেতাম। কী পোশাক পরব, সেসব নিয়ে বসতাম। ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যানসহ বসা হতো। পুরো একটা পরিবার যেন। একটা ছবির কথা বলি। ‘দিল’ ছবি করার সময় আজিজুর রহমানের স্ত্রী সেটে থাকতেন। ভাবি হয়তো শাবনাজের চুল ঠিক করে দিচ্ছেন। আজিজ ভাই বলতেন, নাঈম, তুই এটা পরিস না। এটা পর। এভাবে তখন কাজ হতো।’
হোমওয়ার্কটা যদি ভালো হয়ে যায়, তবে শুটিংটা ভালো হবে। আগে থেকে যদি লাইট কী নেব, কতটুকু কী নেব, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো ঠিক করে নেওয়া যায়, তবে ছবি খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তখন ছবি কম করায় বেশি সময় দিতে পারতাম। তখন কোনো এফডিসির ফ্লোর খালি থাকত না। সর্বত্র শুটিং হচ্ছে। কেউ সিলেটে শুটিং করছে, কেউ কক্সবাজারে আবার কেউ বিদেশে। তখন জমজমাট ছিল সিনেমাটা।
বলা বাহুল্য, খাজা নাঈম মুরাদ তথা চিত্রনায়ক নাঈমের প্রথম ছবি এহ্তেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনী’। এখান থেকে নাঈম-শাবনাজ জুটির যাত্রা শুরু। নাঈম অভিনীত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চোখে চোখে’, ‘সোনিয়া’, ‘দিল’, ‘টাকার অহংকার’, ‘লাভ’, ‘অনুতপ্ত’, ‘জিদ’, ‘বিষের বাঁশি’ ইত্যাদি। তাঁর প্রযোজিত একমাত্র ছবি ‘আগুন জ্বলে’। নাঈম অভিনীত শেষ ছবি ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ২০০১ সালে মুক্তি পায়। এটা নাঈম-শাবনাজ জুটিরও শেষ ছবি। সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার কয়েক বছর পর ‘কাচঘর’ নামে একটা ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন নাঈম। এতে তিনি অভিনয়ও করেন।