এক সন্ধ্যায় ছয় ঋতুর বন্দনা
২৪ ঘণ্টায় এক দিন, ৩০ দিনে এক মাস, ১২ মাসে এক বছর। বছরে ছয়টি ঋতু—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। শিক্ষাজীবনের শুরুতে পাঠ্যবইতে দুলে দুলে মুখস্থ করার অভিজ্ঞতা সবারই আছে। যদিও অধুনা নগরজীবনে টেনেটুনে চারটি ঋতু পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ। তবে যুগ যুগ ধরে এই উপমহাদেশের সাহিত্যে, সংগীতে ছয় ঋতু তথা প্রকৃতি সব সময়ই প্রবলভাবে রয়েছে, যা পাশ্চাত্যের সাহিত্যে তেমন দেখা যায় না। আবহমান বাংলার তেমন কিছু গান কবিতার সম্ভার নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার হেমন্তের সন্ধ্যায় ঋতুর বন্দনা করা হলো।
একটি-দুটি নয়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক আয়োজনে আবহমান বাংলার ছয় ঋতুকে উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘ষড়্ঋতুর পদাবলি’, যেখানে গান, কবিতা আর নৃত্যের ছন্দে শিল্পীরা ঋতুগুলোর বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্য তুলে ধরেন। ছিল রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে লোক এমনকি আধুনিক বাংলা গানও।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সচিব মো. বদরুল আনম ভূঁইয়া এবং প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক কাজী আসাদুজ্জামান।
বন্দনা করা হয় গ্রীষ্মের। একাডেমির শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে শোনা যায় ‘আজি নুতন রতনে ভূষণে যতনে’ গানটি। এরপর ‘দোলে নাগরদোলা দোলে ঘুরে ঘুরে’ গানের সঙ্গে ছিল সম্মেলক নৃত্য। এরপর আবিদা রহমান গেয়ে শোনান ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’ ও মোনালীন আজাদের কণ্ঠে শোনা যায় ‘প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’।
গ্রীষ্মের বন্দনা শেষে বর্ষার গান। শারমিন আক্তার ‘অম্বরে মেঘ মৃদঙ্গ বাজে’, রাফি তালুকদার ‘মাছের গান’, সুচিত্রা রানী সূত্রধর ‘চঞ্চলা হাওয়ারে’ গানে বর্ষার বন্দনা করেন। ‘শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটা’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করেন একদল শিল্পী। সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘মেঘের ডমরু ঘন বাজে’। দ্বৈতকণ্ঠে রোকসানা আক্তার ও রাফি তালুকদার শোনান ‘দাওয়ায় করছে মেঘ’ গানটি।
মোহনা দাসের ‘আমার রাত পোহালো’ গানের একক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঋতু শরতের বন্দনা। এর পর ‘শিউলি তলায় ভোরবেলায়’ গানের সঙ্গে ছিল নৃত্য। আর শরৎ-বন্দনা শেষ হয় ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’ গানটির সমবেত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
ষোলো আনা হেমন্তপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্নতা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। তাই ষড়্ঋতুর পদাবলি অনুষ্ঠানে হেমন্ত পর্বের শুরুতে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটিই যথার্থ মনে হয়েছে। আবৃত্তি করেন কাজী আসাদুজ্জামান। একক আবৃত্তির কারণে মিলনায়তনে কিছুটা নীরবতা নামে। এরপরই শোনা যায় নূপুরের আওয়াজ, ‘আয়রে ও আয়রে’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য। ‘আমার মাইজা ভাই সাইজা ভাই কই গেলা রে’ গানের সমবেত পরিবেশনায় দারুণ জমে ওঠে ঋতুর বন্দনার আসরটি। হীরক রাজার কণ্ঠে ‘কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে কোকিল ডাকে গাছে গাছে’ গীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় হেমন্তের বন্দনা।
যথারীতি পরের ঋতু শীত। শুরুতেই সম্মেলক কণ্ঠে গান ‘পৌষ এল গো, পৌষ এল গো’। পরে ‘একী মায়া লুটাও কায়া জীর্ণ শীতের মাঝে’ গানের সঙ্গে ছিল নৃত্য। হিমাদ্রি রায় গেয়ে শোনালেন ‘পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন’ গানটি। আধুনিক গান ‘যেখানে সীমান্ত তোমার সেখানে বসন্ত আমার’ গানের একক পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় বসন্ত পর্ব।
সব শেষে ঋতুরাজ বসন্তের বন্দনা। এ পর্বের শুরুতেই সোহানুর রহমান গেয়ে শোনালেন। সুচিত্রা রানী সূত্রধর ও মোহনা দাস দ্বৈত কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’। এরপর রোকসানা আক্তার গেয়ে শোনান ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’। সম্মেলক কণ্ঠে শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ঋতু বন্দনার এ আয়োজন।
মঞ্চের পেছনে পর্দায় ছিল নানা ঋতুর নিসর্গ। শিল্পীদের পরিবেশনা, গান, কবিতার বাছাই, গানের সঙ্গে মিল রেখে নৃত্য আর মঞ্চের সাজসজ্জা—সব মিলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আসরে মন ভরে দর্শকের। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন তামান্না তিথি।