ঋতুপর্ণ যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
ঋতুপর্ণ মানেই একসময় আমার কাছে মনে হতো মন খারাপের দিনে মেঘ পিওনের ব্যাগের কথা। কেমন অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করত। তারপর ঋতুপর্ণের বয়স বাড়ল, সঙ্গে আমারও। ধীরে ধীরে পরিচিত হলাম তাঁর চলচ্চিত্রে ‘চোখা চোখা’ ভাষায় ঝগড়া করা, মন ভার করা সংলাপ বলা আর গম্ভীর চিন্তা করা চরিত্রগুলোর সঙ্গে।
দেখলাম যে ঋতুর সিনেমায় আদিগন্ত মাঠ বা খোলা আকাশের দেখা মেলা ভার; বরং সিনেমাগুলোতে জানালার ফাঁক গলিয়ে একচিলতে রোদ্দুরই ভরসা। আমার কিন্তু ওই রোদ্দুরটুকুই বেশ লাগত। তারপর একদিন হঠাৎ ঋতুপর্ণ সুনীল বেশে, কাজল নয়নে অভিসারে যেতে চাইলেন। শোনা গেল বনমালী নয়, পরজনমে রাধা হবেন তিনি। একদিন বললেন, সিনেমা হলের অন্ধকারে নাকি তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে, তাই ঋতুপর্ণ নিজের থেকেই পালাতে চাইছিলেন ক্রমাগত। এরপর এক সকালে শোনা গেল, সত্যিই পালিয়েছেন তিনি। চলে গেছেন অসীমে। বলেছিলেন, ‘সত্যি যদি পরলোক বলে কিছু থাকে, তবে একদিন সন্ধেবেলা, পায়ে হেঁটে পৌঁছব সেখানে।’ তাই ঋতুপর্ণ পরলোকে পৌঁছানোর সেই বিষণ্ন সন্ধ্যায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে, তাঁর রহস্যঘেরা কাজের জগৎ পুনর্পাঠ করবার আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেয়ে বসে।
ফলে সেদিন থেকে আমারও নতুন করে শুরু। ঋতুর সিনেমাগুলো দেখার পাশাপাশি তাঁর লেখার সংকলন ‘ফার্স্ট পার্সন’ নিয়ে বসি একটু ফাঁক পেলেই। পড়তে পড়তে দেখতে পাই, কীভাবে নিজেকে পাল্টে নিচ্ছিলেন ক্রমাগত, সঙ্গে পাল্টে দিচ্ছিলেন চলচ্চিত্রের টেক্সট, খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসছিলেন অনন্য ঋতু। টুক টুক করে পাড়ি জমাচ্ছিলেন মঞ্চতেও।
এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে ভেঙে চলেছেন প্রথা আর মেকিং স্টাইল। সেই উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪) ছবিতে বিধবার গায়ে দিয়ে দিলেন রংচঙে পোশাক, শুধু এটুকুই নয়, গলায় দিলেন মঙ্গলসূত্রও। ছবির গাঁথুনিতে মোহিত দর্শক, তাই এই প্রথাবিরোধিতাকে অকপটে স্থান দিল মনে।
বিধবার গায়ে গয়না আর লাল রং চড়ানো এখানেই থেমে থাকে না। চোখের বালি (২০০৩) চলচ্চিত্রে বিধবা বিনোদিনী হাজির প্রচুর গয়না গায়ে জড়িয়ে। পোস্টারের কেন্দ্রেও ব্যবহার করলেন বিনোদিনীর গয়না জড়ানো ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি (১৯০৩) ইংরেজি অনুবাদ ‘সেন্ড ইন মাই আই’কে ঋতুপর্ণ অনুবাদ করে নিলেন ‘আ প্যাশন প্লে' হিসেবে। হিন্দু বিধবা নারীর জন্য নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা আর গয়নাকে সবার সামনে এনে হাজির করলেন। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবেও সফল হলো। এরপর চিত্রাঙ্গদা (২০১২) ছবির পোস্টারেও একই রকম ছবি দেখতে পাই। তবে এবারের ছবিটি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুদ্রর, যে কিনা একইভাবে গয়না পরে পোস্টারে হাজির। মজার বিষয় হলো, বিধবা বিনোদিনী ও সমকামী রুদ্র দুজনের জন্যই প্রথাগত জায়গা থেকে গয়না নিষিদ্ধ। অথচ এই ছবিও দর্শক গ্রহণ করেছিল।
ঋতুপর্ণ নিজের মতো করে গড়ে-পিটে সিনেমার একটি ধরন দাঁড় করিয়েছেন। ভদ্রলোকের জন্য ছবি বানিয়ে ব্যবসাসফল ছবি করা কঠিন। সত্যজিৎ রায়ের শেষের তিনটি ছবি গুণীজনদের মন কাড়লেও সেভাবে দর্শক টানতে পারেনি। ঋতুপর্ণ সত্যজিৎকে মানতেন গুরু হিসেবে। ১৯৯২ তে চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়। সে বছরই চলচ্চিত্রজগতে পা রাখলেন ঋতুপর্ণ। তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর বড় অংশেই চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বলিউডমুখী হবার ঝোঁক লক্ষ করি। অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বর্য রাই, কিরন খের, রাখি গুলজার, শর্মিলা ঠাকুর, নন্দিতা দাস, সোহা আলি খান, অভিষেক বচ্চন, বিপাশা বসুদের নিয়ে এসেছেন তাঁর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য। আদতে ব্যবসাসফল ছবির জন্য তারকা কাস্টিং একটি কৌশল। ঋতুপর্ণ তাঁর চলচ্চিত্রে সেই কৌশলটিরও সফল প্রয়োগ করেছেন।
প্রথম দিকের কিছু ছবি, উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪), দহন (১৯৯৭), শুভ মহরৎ (২০০৩) ঋতুপর্ণকে নারীবাদী পরিচালক হিসেবেই মনে হতে থাকে। কিন্তু এই চলচ্চিত্রগুলোতে নারীর চিত্রায়ণ অন্যান্য ছবি থেকে আলাদা। অন্যান্য চলচ্চিত্র নারীপ্রধান বা নারীর বয়ানে দেখালেও সেগুলো ঠিক নারীবাদী টেক্সট হিসেবে হাজির হয় না। অবশেষে ঋতুপর্ণই দিলেন সমাধান। কৌস্তব বকশীর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘আমি “ফেমিনিস্ট” নই বরং “উইমেনিস্ট” ফিল্মমেকার।’ শেষের দিকে এসে ঋতুপর্ণের একটা পরিচয় দাঁড়িয়ে গেল ক্যুয়ের পরিচালক (বিষমকামিতা বা প্রথাবদ্ধ যৌন সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে এমন যেকোনো চলচ্চিত্রনির্মাতা) হিসেবে। শেষের তিনটি চলচ্চিত্রের (যার মধ্যে দুটিতে অভিনয় এবং একটিতে নির্দেশনা দিয়েছেন) কারণেই হয়তোবা।
এই যে ‘ফেমিনিস্ট’ থেকে ‘উইমেনিস্ট’ হয়ে ক্যুয়ের ছবি বানানোর যাত্রা। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটা আদতে তাঁর নিজ জেন্ডার ও যৌনতার সঙ্গেই বোঝাপড়া সারার একটি প্রক্রিয়া। নিজের ছবির সঙ্গে জীবনকে মিশিয়ে দিতে পারতেন বলেই ঋতুপর্ণ অনন্য।’
ঋতুপর্ণই প্রথম, যিনি জেন্ডার তারল্য (ফ্লুইডিটি) নিয়ে কথা বলেছেন প্রকাশ্যে। আরেকটি প্রেমের গল্প (২০১০) তে চলচ্চিত্রকার অভিরূপ এবং অভিনেতা চপল ভাদুড়ীর মধ্যে কথোপকথনের দৃশ্যে অভিরূপ বলে, ‘মেয়েরা আলাদা, ছেলেরা আলাদা আর আমরা আলাদা।’ আবার চিত্রাঙ্গদা (২০১২) চলচ্চিত্রে নারী হয়ে উঠবার জন্য মূল চরিত্র রুদ্র যেসব সার্জারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, চলচ্চিত্রের শেষে সে কিন্তু আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে চায়। কারণ, ‘নকল’ নারী নয়, বরং নিজ জেন্ডার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাটাই সম্মানের বলে মনে করেছিল রুদ্র।
আবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও ঋতুপর্ণ বলেছেন, জেন্ডার আদতে তরল, এর পরিসর বিশাল। ফলে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড এ বিষয়টাকে আটকে ফেলা বোকামি। দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জেন্ডার তারল্যের জন্য নিজেকে সুবিধাপ্রাপ্ত মনে করি। সত্যি বলতে আমি হলাম দুটোর মধ্যবর্তী। আমি নিজেকে নারী মনে করি না এবং আমি নারী হতেও চাই না।’ এ জন্যই চলচ্চিত্রে চরিত্রের প্রয়োজনে এক-দুবার শাড়ি পরলেও ব্যক্তিগত জীবনে, মিডিয়ায় বা নিজ ডিরেকশনের ছবিতে তিনি হাজির হতেন এমন সব পোশাকে, যেগুলো নারী-পুরুষনির্বিশেষে পরতে পারে। বিভিন্ন সময়ে চলতি জনপ্রিয় পোশাকের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধও করেছেন তিনি। মজার বিষয় হলো, বাংলা ভাষাকে তিনি জেন্ডার নিরপেক্ষ বলতেন। বলতেন, এই ভাষায় উভলিঙ্গীয় রহস্য আর মিথ লুকিয়ে আছে। তাই এই ভাষায় নিজের কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন আর পোশাকের রাজনীতিতে নিজেকে হাজির করেছিলেন নতুন আইকন হিসেবে।
ঘোষের চলচ্চিত্রের মজা হলো, খুব ছিমছাম গল্পের মধ্যে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু করবার ইচ্ছেটা। বাড়ীওয়ালি (২০০০) চলচ্চিত্রে শহুরে-ভদ্রলোক চলচ্চিত্রনির্মাতা দীপঙ্কর, বনেদি পরিবারের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী বনলতার বাড়িটি শুটিংয়ের কাজে ব্যবহার করে। নিজ স্বার্থে, সে বনলতার সীমানার দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে বারবার। কিন্তু প্রয়োজন শেষে, তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না। এমনকি দীপঙ্করের চলচ্চিত্র থেকে বনলতার পার্টটুকুও বাদ পড়ে। এই নিপীড়নটুকুর চিত্রায়ণের পাশাপাশি চলচ্চিত্রটিকে আলাদা মাত্রা দেয় বনলতার পুরাতন ভৃত্য প্রসন্নর উপস্থিতি। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রসন্নকে ঋতুপর্ণ একটি ক্যুয়ের চরিত্র হিসেবে হাজির করেছেন। বনলতার স্বপ্নদৃশ্যে প্রসন্নকে শাঁখা-সিঁদুরসহ স্ত্রীর আচার করতে দেখি। ঠিক একইভাবে শুভ মহরৎ (২০০৩) এ মল্লিকাকে অরিন্দম আর শুভঙ্কর—দুজনের জন্যই প্রেম অনুভব করতে দেখি।
মল্লিকা এমনও প্রশ্ন করে যে একসঙ্গে দুজনকে ভালোবাসা যায় কি না। উৎসব (২০০০) এ ভাইবোন শম্পা আর জয়ের মধ্যকার সম্পর্ক বা উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪) এ হালকা করে ছুঁয়ে যাওয়া, বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মধ্যকার ইলেকট্রা কমপ্লেক্স অথবা তিতলীতে (২০০২) মা ও মেয়ের একই পুরুষের প্রেমে পড়ার আর স্টেরিওটাইপ ভেঙে মাকে রোমান্টিক ও আকর্ষণীয় হিসেবে হাজির করেছেন ঋতুপর্ণ। ফলে প্রতিটি চলচ্চিত্রের সাবটেক্সটে মূলত তিনি জেন্ডার ও যৌনতার মধ্যে আত্মপরিচয়টাকে খুঁজে ফিরছিলেন। নিজেকে খোঁজার ফাঁকে বদলে দিচ্ছিলেন দর্শকের রুচি, বদলে চলেছিলেন চলচ্চিত্রের টেক্সট। আর পাচ্ছিলেন ব্যবসাসফল সব ছবি।
সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে খেলাটা ঋতুপর্ণের প্রিয় কাজ। সঙ্গে জটিল এডিটিং। একসঙ্গে দুটি কখনো তিনটি গল্প বলে গেছেন অসাধারণ নিপুণতায়। চলচ্চিত্র শেষে এসে দেখা গেছে, সব কটি আদতে একটাই গল্প। আবহমান (২০০৭) এখানে এসেই ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রজুড়ে তিনটি বয়ান সমান্তরালে হাজির হয়। নটী বিনোদিনীর গল্প, অনিকেতের মৃত্যুর দিন আর দিপ্তী-অনিকেত-শিখার সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই যে জটিল বয়ান রীতি, চলচ্চিত্রটি বুঝতে কিন্তু দর্শকের এতটুকু কষ্ট হয় না। প্রায় একই রীতিতে নির্মাণ করতে দেখি সব চরিত্র কাল্পনিক (২০০৯) চিত্রাঙ্গদা (২০১২) এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বানানো তাঁর সর্বশেষ ডকু-ড্রামা জীবন স্মৃতি (২০১৩)ও।
আমার ঋতুপর্ণ পাঠ চলছে এখনো। পরপারে চলে না গেলে এ বছর ঋতুর বয়স হতো ৫৭ বছর। বেঁচে থাকলে জেন্ডার ও যৌনতার পরিসরে আরও নতুন পাঠ হাজির করতেন আমি নিশ্চিত। মঞ্চের কাজগুলো হয়তো গুছিয়ে নিতেন আরও খানিকটা। জটিল চলচ্চিত্র ভাষায় বলা, জটিল মনস্তত্ত্বের গল্পগুলো হয়তো আবারও ছুঁয়ে যেত বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শকের মন। আলোচনায় সরব করে দিতেন আড্ডার টেবিল। নতুন গয়নায় সাজাতেন নিজেকে। নিজ অবয়ব নিয়ে প্রান্তজনের মুখপত্র হয়ে, প্রশ্ন হাজির করতে থাকতেন প্রথাবদ্ধ সমাজের সামনে। আবারও কোনো আড্ডায় হয়তো বলে উঠতেন, ‘এ শহর (কলকাতা) আমাকে গ্রহণ করতে পারে না, আবার ফেলে দিতেও পারে না।’ কিন্তু ঋতুপর্ণকে ফেলে দিলে বাংলা চলচ্চিত্র থেকে হারিয়ে যায় একটি বিশেষ যুগপর্ব। এতই সহজ ঋতুপর্ণকে ফেলে দেওয়া?
লেখক: শিক্ষক
জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া কম্যুনিকেশন বিভাগ
গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ