অসহায় এক মেয়ের কথা
তাঁর দিকে বুঝি তাকাতে হয় শুধুই লোভাতুর চোখে—এমনই একটা ধারণা গড়ে উঠেছে সবার মধ্যে। মেরিলিন মনরো মানেই যেন যৌনতা। মেরিলিন মনরো মানেই পুরুষের হৃদয় ভেঙে দেওয়া এক অনির্বচনীয় মহাকাব্য। বাইরের এই ভাসা ভাসা ধারণা দিয়েই গড়ে উঠেছে মেয়েটার ভাস্কর্য। অথচ যদি তাঁর দিকে একটু সহজ চোখে তাকানো যায়, দেখা যাবে ওই মহাকাব্য হতে গিয়ে তিনি অর্ধসমাপ্ত এক উপন্যাসেই ঠেকে গেছেন। জীবনের জৌলুসের চেয়ে হৃদয়ের কান্নাটাই তখন ভেসে উঠবে অনেক বেশি, প্লাবনের মতো তা আছড়ে পড়বে মনভূমিতে।
ধর্ষণচেষ্টা আর আত্মহত্যার চেষ্টা
শৈশব থেকেই সুখের কাঙাল ছিল মেয়েটা। চরম নিরাপত্তাহীনতা কাকে বলে, নরমা জিন মোর্টেনসোন নামে পরিচিত মেয়েটা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বাবা ছিল না। মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। মাত্র ২ সপ্তাহ বয়স যখন, তখনই অন্য এক পরিবারে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে। সেখানেই সে ছিল ৭ বছর বয়স পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে মায়ের দেখা পাওয়া যেত। ৭ বছর বয়সে কী হলো কে জানে, মা এলেন সন্তানকে নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মা হারাতে থাকলেন মানসিক ভারসাম্য। কোনো এক মানুষকে ছুরি নিয়ে তাড়া করায় মায়ের ঠিকানা হলো মানসিক হাসপাতালে। এরপর নরমার ঠিকানা হলো এতিমখানায় আর কখনো কখনো কয়েকটি পরিবারে। ১২ বছর বয়সেই অন্তত ২ বার ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে গেছে—প্রথমবার সৎবাবা আর দ্বিতীয়বার চাচাতো ভাইয়ের কীর্তি। পুরুষদের সম্পর্কে এর পর থেকেই তাঁর মনে জমে ঘৃণা, অবিশ্বাস। তবে একজন পুরুষকে তিনি মনপ্রাণ উজাড় করে ভালো বেসেছিলেন, তিনি জন এফ কেনেডি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁদের সখ্য। সেই ভালোবাসার কারণে জ্যাকুলিনের সংসারে আগুন লেগে গিয়েছিল।
এই মেরিলিনই বলেছিলেন, ‘যৌনতা বা যৌনতাবিষয়ক সমস্যাকে আমি জুতা পরিষ্কার করার চেয়ে বেশি মূল্য দিইনি।’ বলেছিলেন, ‘কেন মানুষ যৌনতা নিয়ে এত আগ্রহী, সেটা যদি কখনো জানতে পারতাম, তাহলে আমি সুখী হতাম।’ হ্যাঁ, এই মেরিলিনই বয়স ১৯ হওয়ার আগেই ২ বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
প্রথম বিয়ে
মেরিলিন প্রথম বিয়ে করেন ১৬ বছর বয়সে, ১৯৪২ সালে। বিয়ে করে স্কুল ছেড়ে দেন। স্বামী জিম ডগার্টির বাড়িতে চলে আসেন। এই বিয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফের এতিমখানায় যেন গিয়ে পড়তে না হয়। কারণ সে সময় যে বাড়িতে দত্তক ছিলেন মেরিলিন, সে বাড়ির লোকেরা এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁরা চাইছিলেন না মেরিলিনও তাঁদের সঙ্গে যাক। ফলে সেই বাড়ির লোকেরা চাইছিলেন বিয়েটা হোক। বিয়ের এক বছর পরই জিম যুদ্ধে গেলেন আর মেরিলিন কাজ নিলেন বিমানবাহিনীর কারখানায়।
ফটোগ্রাফারের দল
নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন মেয়েরা কীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্য এই বিমানবাহিনীর সেই কারখানায় এলেন পরিচালক আর ফটোগ্রাফারের দল। এই দলেই ছিলেন ফটোগ্রাফার কনোভার। তিনি মেরিলিনের মধ্যে খুঁজে পেলেন মডেল। তিনি অফার দিলেন, ঘণ্টায় ৫ ডলার করে দেবেন মেরিলিনের ছবি তোলার জন্য। মেরিলিন সানন্দে রাজি হলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই মেরিলিন কারখানার কাজ ছেড়ে দিলেন। মডেল হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরলেন জিম। তাঁর পছন্দ হলো না মেরিলিনের এই কাজ। তিনি শর্ত দিলেন মেরিলিনকে—হয় ক্যারিয়ার, নয় পরিবার। ক্যারিয়ারকেই বেছে নিলেন মেরিলিন। সে সময় প্রযোজকেরা খুঁজছেন অবিবাহিত মেয়েদের। তাই এই বিয়ের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল।
শৈশব ও বিষণ্নতা
২০ বছর বয়সী মেরিলিন তো ধ্রুপদি সুন্দরী ছিলেন না। বিভিন্ন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে হাস্যোজ্জ্বল যে নারীর ছবি দেখা যেত, সেগুলো কি শৈশব থেকে লালন করা বিষণ্নতাকে ঢেকে দিতে পারত? মেরিলিন মনরো নিজেই বলেছেন, ‘কেউ কোনো দিন আমাকে মেয়ে বলে ডাকেনি, কেউ কোনো দিন আমাকে আদর করে বুকে টেনে নেয়নি, কেউ আমাকে চুমুতে ভরিয়ে দেয়নি। যখন কোনো শিশু বুঝতে পারে সে একা, তার কেউ নেই, তখন সে কোনো দিন নিজের একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।’ কেউ মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করলে ‘মেরিলিন মনরো সিনড্রোম’–এর কথা জানতে পারবেন। শৈশবে ভালোবাসা, মনোযোগের অভাব ঘটে যাদের, তারাই এই সংকটে ভোগে।
নাম হলো মেরিলিন মনরো
১৯৪৬ সালের আগস্টে ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স’ স্টুডিওতে যোগ দিলেন নরমা। এখানেই তাঁকে সিনেমার জন্য নিজের নাম বেছে নিতে বলা হয়। ক্যারল লিন্ড, ক্ল্যার নরম্যান, মেরিলিন মিলার নামগুলো ভাসতে থাকে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় মেরিলিন মনরো। মনরো পদবিটা ছিল নানুর। ১৯৫১ সালে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছাল যে প্রতি সপ্তাহে তাঁর কাছে আসতে লাগল ২ থেকে ৩ হাজার চিঠি। ১৯৫৫ সালে ‘মেরিলিন মনরো প্রডাকশন’–এর জন্ম দিলেন তিনি।
দ্বিতীয় বর
১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে বেসবল খেলোয়াড় জো ডিম্যাজিওর সঙ্গে বিয়ে হয় মনরোর, যা টেকে মাত্র ৯ মাস। এই বিয়ের পর পরই টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স থেকে দেয়ারস নো বিজনেস লাইক শো বিজনেস চলচ্চিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব পান। জো খুবই ঈর্ষান্বিত ছিলেন। চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে কী হয় না হয়, তা নিয়েই ছিল ঈর্ষা। মান ভাঙাতে মেরিলিন যেদিন জোকে নিয়ে গেলেন স্টুডিওতে, সেদিনই ছিল দ্য সেভেন ইয়ার ইটস ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্যের অভিনয়। বাতাসে ভেসে যাচ্ছে মেরিলিনের ফ্রক। ব্যস! এরপর কি আর বিয়ে টেকে?
আর্থার মিলারের সঙ্গে জীবন
১৯৫০ সালে আর্থার মিলারের সঙ্গে পরিচয় হয় মনরোর। এরপর আবার দেখা ১৯৫৫ সালে। এই সময় বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল মিলারের। আগের বিয়ের পর তাঁর ছিল দুই সন্তান। ১৯৫৬ সালে আর্থার মিলারের সঙ্গে বিয়ে হয় মনরোর। এই বিয়েটা অন্য দুই বিয়ের তুলনায় দীর্ঘ আয়ু পায়। তবে বিবাহিত জীবন সুখকর হয়নি। সাড়ে ৪ বছরের বিবাহিত জীবনের (বিয়ে ভেঙে যায় ১৯৬১ সালের ১০ জানুয়ারি) শুরুতেই আর্থার মিলার তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, ও একটা ছোট বাচ্চা। আমি ওকে ঘৃণা করি।’ অনেক দিন পর মনরোর চোখে পড়ে ডায়েরির এই লেখাটুকু। এই লেখা দেখে খুবই কষ্ট পান মেরিলিন। এরপর শুরু করেন ঝগড়া। পরে মনরো বলেছেন, ‘আর্থার মিলার একজন ভালো সাহিত্যিক, কিন্তু খুব ভালো স্বামী নন’।
সন্তানের জন্য হাহাকার
মেরিলিন সব সময়ই সন্তান চাইতেন। জো আর আর্থারের সঙ্গে বিবাহিত জীবনে তিনি বারবার মা হতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর শরীর সন্তান ধারণে সমর্থ ছিল না। বলা হয়ে থাকে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন আর মদ্যপানের জন্যই সমস্যা হয়েছিল। আর্থার মিলারের সঙ্গে বিবাহিত জীবনের সময় তিনি সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা রাখা যায়নি। এরপর আরও বেশি ডিপ্রেশনে পড়ে যান মেরিলিন। আরও বেশি মদ্যপান শুরু করেন, আরও বেশি ওষুধ সেবন করতে থাকেন।
জন এফ কেনেডি ও মৃত্যু
১৯৬১ সালের ১৯ মে ম্যাডিসন স্কয়ারে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির জন্মদিনে মেরিলিন মনরো ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ গেয়ে শোনান। কেনেডির সঙ্গে ১৯৫১ সাল থেকেই সখ্য মনরোর। কেনেডির সঙ্গে তাঁর প্রেমের খবর ঘুরে বেড়াত বাতাসে। রবার্ট কেনেডির সঙ্গেও প্রেম ছিল তাঁর। কিন্তু এই ঘটনাগুলো গুজবে যতটা শক্তিশালী, বাস্তবে ততটা ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
এ সময় মেরিলিন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাদকের মাত্রা। জো ডিম্যাজিও এলেন তাঁকে বাঁচাতে। তাঁরা ঠিক করলেন, ১৯৬২ সালের ৮ আগস্ট আবার বিয়ে করবেন। কিন্তু ৪ আগস্ট বিকেলে মেরিলিনকে তাঁর ঘরে পাওয়া গেল, প্রাণহীন।