পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশে কাজ করতেন আব্বাস
১৯৭০–এর দশকেই সাড়া জাগিয়েছিলেন ইরানে। দেশের অনেক মানুষের কাছে একসময় তিনি আইকনে পরিণত হন। সিনেমা দিয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ থেকে গোটা বিশ্বে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের নতুন সম্ভাবনার দ্বার সূচিত করা মানুষটির নাম চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি। আজ ২২ জুন তাঁর জন্মদিন। একসময় পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশে কাজ করতেন আব্বাস। তারপরের গল্প যেন সিনেমার মতোই। শিশুদের জন্য ভিডিও বানানো এক শিক্ষক কীভাবে চলচ্চিত্রবিশ্বে জায়গা করেন নেন? কেন এখনো তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক?
কিয়ারোস্তামি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়াশোনা করে গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করে। তখনো সিনেমা তাঁকে ততটা পায়নি। সে সময়ই তিনি শিশু–বয়স্কদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে (দ্য সেন্টার ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়াং অ্যাডাল্ট) যোগ দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়, পাঠদানের চেয়ে শিশুদের ভিজুয়াল কোনো মাধ্যমে শেখালে কেমন হয়? এই প্রথম শিশুদের জন্য হাতে তুলে নেন ক্যামেরা। বানিয়ে ফেলেন ভিডিও চিত্র, যার মূল বিষয় ছিল, একটি ছোট শিশুর হাতে রুটি। এটি কিনে শিশুটি বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ একটি কুকুর তার পিছু নেয়। একসময় সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ে কুঁকড়ে যায় শিশুটি। এমন পরিস্থিতিতে শিশুরা কী করবে?
এমন প্রশ্নে ইরানের অভিভাবকেরাও তখন শঙ্কিত ছিলেন। কারণ, রাস্তায় প্রায়ই কুকুর দেখে শিশুরা ভয় পেত। ভিডিওটিতে এর উত্তর দেন কিয়ারোস্তামি। তিনি ভিডিওতে দেখান, শিশুটি নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরে তার মাথায় বুদ্ধি খেলা করে। রুটির কিছুটা অংশ ছুড়ে ফেললে দেখা যায়, কুকুর সেটা খেতে থাকে। কিছুটা দূরে ছুড়ে দিলে কুকুরও দূরে দৌড়ে চলে যায়। কুকুর তখন শিশুটির বশ্যতা মানে। এ সময় শিশুটি দৌড়ে তার বাসায় চলে আসে।
প্রথম শিক্ষনীয় ভিডিও শর্ট ‘ব্রেডস অ্যান্ড অ্যালি’ বানিয়েই প্রশংসা পান এই পরিচালক। পরবর্তী বেশির ভাগ কাজেই বেছে নেন শিশুদের। শিশুদের নিয়ে প্রথম কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিয়ারোস্তামি বলেছিলেন, ‘ব্রেড অ্যান্ড অ্যালিই আমাকে সিনেমা বানানোতে আকর্ষণ করে। কাজগুলো শিশুতোষ সমস্যা নিয়ে নির্মিত হতো। শুরুতে সেটা ছিল আমার চাকরির অংশ। এই কাজই আমাকে শিল্পী করে তুলেছে। একই সঙ্গে শিখিয়েছে, সিনেমা বানানো কঠিন কাজ।’ একাধিক শিক্ষণীয় ভিডিও বানিয়ে কিয়ারোস্তামি শুরু করেন প্রথম সিনেমা ‘দ্য রিপোর্ট’ নির্মাণের কাজ।
গল্প শোনানোর চেয়ে গল্প শোনার আগ্রহ ছিল কিয়ারোস্তামির। কাজ করতে গিয়ে সবার আগে প্রাধান্য পেত গল্প শোনা। শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে গল্প শুনতেন। বাস্তবের সেসব গল্প ‘দ্য এক্সপেরিয়েন্স’, ‘দ্য ট্রাভেলার’, ‘আ স্যুট ফর ওয়েডিং’, ‘ক্লোজ আপ’সহ প্রায় সব সিনেমায় স্থান পায়। তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে। তত দিনে তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে যায় কালো চশমা পরা পরিচালক, যাঁর কাজের প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়ায় ইরানের অদেখা গ্রামের গল্প। সেগুলো চিত্রকরের আঁকা ছবি হয়ে কিয়ারোস্তামির ক্যামেরায় ধরা দিতে থাকে। বিশ্বের সিনেমা সমালোচকদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সিনেমার কবি। তাঁর সিনেমায় মুখ্য হয়ে ওঠে দীর্ঘ সময়ব্যাপ্তির শট, সংলাপের অযথা ব্যবহার না করে ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্যপট-গল্পকে কাজে লাগানো।
আয়োজন খুবই কম। গ্রামের লোকেশন আর অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের কাজে লাগান কিয়ারোস্তামি। সিনেমায় ভয়েস ওভারে সরাসরি পার্সিয়ান কবিতার লাইনগুলো যেন মুগ্ধতা বাড়িয়ে তোলে। কিয়ারোস্তামির বিচিত্র সব ভাবনা বিচিত্র সব পথে গেছে এবং তিনি যা নির্মাণ করেছেন, তার সব কটিই অর্জন করেছে নতুন নতুন অর্থ। এমনকি এ সময় ‘এবিসি আফ্রিকা’ বা ‘টেন অন টেন’-এর মতো যেসব তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, তা–ও অনন্য। ‘সার্টিফায়েড কপি’, ‘শিরিন’ ও ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ ছবিগুলোর কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার।
কান চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব যেটাই বলি, তাকে শুনতে হতো, অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা কতটা কঠিন? তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে সবচেয়ে বেশি গ্রামের গল্পগুলো টানে। আর আমি কখনোই পুরো গল্প লিখি না। চিত্রনাট্যও না। যখন চরিত্রগুলো খুঁজে পাই, তখন তাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাই। খুব কাছ থেকে তাদের জানার চেষ্টা করি। বাস্তবের চরিত্রের সঙ্গেও কথা বলে বোঝার চেষ্টা করি। এই প্রক্রিয়ায় আমাকে দীর্ঘ ছয় মাসের মতো সময় দিতে হয়। এ সময় আমি শুধু নোট নিই। পুরো গল্পটি মাথায় নেওয়ার পর আমি চিত্রনাট্য লেখা শুরু করি। পরে শুটিং শুরু করি। কিন্তু কোনো মহড়া করি না। কিন্তু মূল চরিত্রের মতো আমি তাদের অনেক কাছে চলে যাওয়ার চেষ্টায় থাকি।’
চার যুগের ক্যারিয়ারে কিয়ারোস্তামির ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে ইরানের গ্রামের অনেক না বলা গল্প। বাস্তবতা ও কল্পনার আশ্রয়ে তাঁর সিনেমাগুলো কাব্যিক হয়ে ধরা দেয় বিশ্ববাসীর কাছে। তাঁকে তুলনা করা হয় সত্যজিৎ রায়, ভিত্তো ডি সিকা, জ্যাকুয়িস টাটিদের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে। এর অন্যতম কারণ ছিল, কিয়ারোস্তামির প্রতিটি কাজই ছিল নিরীক্ষামূলক। সব সিনেমায়ই চিত্রায়ণে ভিন্নতা নিয়ে কাজ করতেন, ভিন্ন ধরনের নির্মাণপদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে কাজ করতেন। এসব নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কম বাজেটে কীভাবে সিনেমা বানানো যায়, ইরানের তরুণ নির্মাতাদের সেটা দেখানো।
বলে রাখা দরকার, ৭০ দশকে যখন ইরানিয়ান নিউ ওয়েব জাগ্রত হচ্ছে, তখনই দারিউস মেহের জুঁইয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন কিয়ারোস্তামি। ইরানিয়ান নিউ ওয়েব প্রতিষ্ঠায় তিনিও ভূমিকা রাখেন। ‘ক্লোজ আপ’, ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’, ‘টেস্ট অব চেরি’, ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম?’ সিনেমাগুলো সে কথাই বলে। রাজনৈতিক বাধাও তাঁকে দমাতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর অনেক শিল্পীই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, কিয়ারোস্তামি তখন ইরানেই নতুন সরকারের কঠোরতার মধ্যেই নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। বাস্তবতা ও রাজনৈতিক মিশেলে গল্পগুলো দিয়ে একের পর এক সিনেমা বানিয়েছেন। তাঁর নির্মাণের বৈচিত্র্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আব্বাস কিয়ারোস্তামি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি গভীর মনস্তাত্ত্বিক রাজনৈতিক বক্তব্যের সিনেমা বানান। যেসব সিনেমার অর্থ সহজেই ইরানের প্রশাসনের বোধগম্য হতো না।
কিয়ারোস্তামি ‘থ্রো দ্য অলিভ ট্রি’ দিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে পামদ’রের জন্য মনোনয়ন পান। তিন বছর ‘টেস্ট অব চেরি’র জন্য কান উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার জয় করেন। শুধু কানই নয়, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেও গ্র্যান্ড প্রাইজসহ একাধিক পুরস্কার জয় করেছেন। ইউনেস্কোর স্বর্ণপদকসহ বিশ্বের একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন এই পরিচালক, লেখক, কবি ও প্রযোজক। কিয়ারোস্তামি ১৯৪০ সালে তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৪ জুলাই ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।