অস্থির বিশ্বে নানামুখী লড়াইয়ের চিত্রে সাজানো টোকিও চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৪

সমাপ্তি অনুষ্ঠানের উৎসব মঞ্চে মূল প্রতিযোগিতার বিজয়ীরাছবি: টিফ ২০২৪

টোকিওতে এখন শীতের আমেজ, পথে-ঘাটে, উদ্যানে শরতের ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি। অন্যদিকে বিশ্বের নানা প্রান্তে এখনো চলছে যুদ্ধের দামামা, গোলাবারুদের আগুনে পুড়ছে মানুষের ঘরবাড়ি, জীবন, সংসার, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ। সেই উত্তাপের ঢেউ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ভৌগোলিক অবস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ছে তার ঢেউ, ঢাকা থেকে টোকিও, লিসবন থেকে নিউইয়র্ক কিংবা বেনিন থেকে বোগোতার নিত্যকার জীবনে তার ছোঁয়া। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবনে উঠেছে নাভিশ্বাস। এক মহামারি পাড়ি দিয়ে আরেক মহাসংকটের মুখোমুখি মানুষ। জীবনের এই নিত্য লড়াইয়ের মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখে আগামী দিনের। লড়ে যায় তার নিজস্ব সম্বল কিংবা অনুষঙ্গ নিয়ে। কেউ কেউ সেই সংগ্রাম আর স্বপ্নের ছবিগুলোকে ধরে রাখতে চান চলচ্চিত্রের ভাষায়। চলচ্চিত্র তো শেষ পর্যন্ত যাপিত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের এ রকম নানামুখী লড়াইয়ের ভিন্ন ভিন্ন আদলের নির্মাণ নিয়েই গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (টিআইএফএফ বা টিফ) ৩৭তম আসর। সমাপনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে ১০ দিনব্যাপী এই বিশাল আয়োজনের।

টিফ হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বনেদি চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর অন্যতম। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে আকিরা কুরোসাওয়ার সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়ে।

শুরুতে দ্বিবার্ষিক উৎসব হিসেবে টিফের আয়োজন করা হলেও ১৯৯০–এর দশকের সূচনালগ্ন থেকে এটা বার্ষিক আয়োজনে রূপান্তরিত হয়। ফলে বছর গণনার হিসাবের দিক থেকে টিফের বয়স আগামী বছর চল্লিশে পদার্পণ করতে যাওয়া সত্ত্বেও এ বছরের আয়োজন ছিল ৩৭তম।

আরও পড়ুন
সেরা ছবির পুরস্কার পাওয়া ‘টেকি কামেথ’–এর পরিচালক ইয়োশিদা দাইহাচি
ছবি: টিফ ২০২৪

১০ দিন ধরে চলা চলচ্চিত্র উৎসবের পুরো সময়ে টোকিওর কেন্দ্রস্থলের হিবিয়া-ইউরাকুচো-মারুনোউচি অঞ্চলটি হয়ে উঠেছিল উৎসবমুখর। অতীতে একসময় এলাকাটি ছিল জাপানের রাজধানীর মূল সিনেমাপাড়া। টিফের আয়োজকেরা বেশ কয়েক বছর ধরে টোকিওর অন্য কয়েকটি এলাকায় উৎসবের আয়োজন করার পর বছর তিনেক আগে ফিরে এসেছেন টোকিওর সিনেমাপাড়া হিসেবে বিবেচিত এলাকায়।
মূল প্রতিযোগিতা ও অন্যান্য বিভাগের জন্য মনোনীত হওয়া ছবির বাইরেও প্রতিযোগিতার জন্য জমা হওয়া ছবির মধ্য থেকে বেছে নেওয়া দুই শতাধিক চলচ্চিত্র এ বছর এলাকার বিভিন্ন সিনেমা হলে দর্শকদের জন্য দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছবি দেখার সুযোগ জাপানের রাজধানীর চলচ্চিত্র অনুরাগীরা এই সময়ে পেয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে ছিল ছায়াছবি–সংক্রান্ত বিভিন্ন সেমিনার ও সমাবেশ এবং মূল কয়েকটি প্রতিযোগিতা বিভাগের জন্য নির্বাচিত ছবির পরিচালক, অভিনেতা ও অন্যদের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়া। এ ছাড়া অনেকটা একই সময়ে আয়োজন করা হয় টিফ-কম নামে পরিচিত ছায়াছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা রকম বাণিজ্যিক দিকের ভিন্ন একটি মেলা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের চলচ্চিত্র পরিবেশক, বিনিয়োগ কোম্পানি ও ছবির শুটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া দেশ কিংবা অঞ্চলভিত্তিক ফিল্ম কমিশনের প্রতিনিধিরা যেখানে যোগ দিয়েছিলেন বাণিজ্যিক যোগযোগ সম্প্রসারিত করার সুযোগ নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে।

ফলে টিফ সার্বিক অর্থেই নানা রকম যেসব দিকের সমন্বয়ে চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশ, তার এক সার্বিক প্রতিফলন। প্রতিবছরের মতো এবারও উৎসবের নেভিগেটরের ছবি সংযুক্ত করে প্রকাশিত পোস্টার এলাকার বিভিন্ন সড়কজুড়ে শোভা পাচ্ছিল। এবারের উৎসবের নেভিগেটর ছিলেন জাপানের গণ্ডি পার হয়ে বিদেশেও পরিচিত হয়ে ওঠা জাপানি অভিনেত্রী রিংকো কিকুচি।
এ বছরের উৎসবের জন্য মোট ছবি জমা পড়েছিল ২ হাজার ২৩টি, সংখ্যাগত দিক থেকে যা হচ্ছে গত বছরের চেয়ে ৮১টি বেশি। ১০ দিন ধরে চলা উৎসবে সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের ভিড়ও ছিল উৎসাহজনক। ফলে আয়োজকেরা মনে করছেন, করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।

অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড জেতা ‘বিগ ওয়ার্ল্ড’ ছবির একটি দৃশ্য
ছবি: টিফ ২০২৪

এবারের টিফ সাজানো হয়েছিল মোট ২০৮টি চলচ্চিত্র দিয়ে। এর মধ্যে প্রতিযোগিতা বিভাগে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে জমা হওয়া বিপুলসংখ্যক চলচ্চিত্র থেকে নির্বাচিত ১৫টি প্রদর্শিত হয়েছে। উৎসবের ছবিগুলোর দর্শন এই বোধের জানান দেয় যে বিশ্বের চলমান অস্থিরতার মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সবাই কোনো না কোনো সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং সেগুলোকে চিত্রায়িত করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন চলচ্চিত্রিক কৌশল ব্যবহার করছেন। যার ফলস্বরূপ এবারের উৎসবে ডার্ক কমেডি থেকে ট্র্যাজেডি, ভৌতিক ঘরানা থেকে ওয়েস্টার্ন কিংবা বাস্তববাদী চলচ্চিত্র থেকে ফ্যান্টাসি—এ রকম নানা চলচ্চিত্রের দেখা মিলেছে। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারেও এবারের উপস্থিতি ছিল বিচিত্র। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে উৎসবে। প্রতিযোগিতা বিভাগে ইউরোপ থেকে এবার প্রতিনিধিত্ব করেছে ফ্রান্স, পর্তুগাল, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়ার মতো দেশের চলচ্চিত্র। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার দুটি শক্তিশালী চলচ্চিত্রও এবার নির্বাচিত হয়েছে।

তবে প্রতিযোগিতা বিভাগে সিংহভাগ উপস্থিতি ছিল এশীয় চলচ্চিত্রকারদের। যেমন আগের বছরের মতো এবারও চীন থেকে তিনটি চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয়েছে, যা সমকালীন চীনা চলচ্চিত্রের উচ্চমানকে তুলে ধরে। ছিল তাইওয়ানেরও একটি ছবি। অন্যদিকে তিনটি জাপানি চলচ্চিত্রও এবার স্থান করে নিয়েছে এই বিভাগে, যার মধ্যে একটি ছিল জাপান ও তাইওয়ানের যৌথ প্রযোজনা। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মধ্য এশিয়ার চলচ্চিত্রের দেখা মিলছে উৎসবে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাজাখস্তানের আদিলখান ইয়েরজানোভ নিজেই উপস্থিত ছিলেন ‘ক্যাডেট’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে। তবে লক্ষণীয় ছিল এবার মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে ইরানি চলচ্চিত্রের অনুপস্থিতি এবং অন্যান্য বিভাগেও কোনো পুরস্কার না পাওয়ার বিষয়টি।

বিশেষ জুরি পুরস্কারজয়ী ‘আদিওস আমিগো’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: টিফ ২০২৪

উৎসবের শীর্ষ পুরস্কার টোকিও গ্রাঁ প্রি ও টোকিও গভর্নর পুরস্কার পেয়েছে প্রতিযোগিতা বিভাগের ইয়োশিদা দাইহাচি পরিচালিত ‘টেকি কামেথ’ বা ‘শত্রু আসছে’ শীর্ষক চলচ্চিত্রটি। এটি একটি ডার্ক কমেডি ঘরানার ছবি, যার মাধ্যমে ওয়াতানাবে গিসুকে নামক একজন ৭৭ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অবসরকালীন একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা নিত্যকার জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে। স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি তাঁর পিতামহের নির্মিত একটি পুরোনো ধাঁচের জাপানি বাড়িতে একা বসবাস করেন। নিজের জন্য রান্নাবান্নার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে তাঁর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের ডিনার কিংবা পানাহারের জন্য আমন্ত্রণ জানান তিনি। শান্তিপূর্ণভাবে একটি নিখুঁত জীবনযাপনকারী অধ্যাপক কখনো কখনো এই দুর্মূল্যের বাজারে তাঁর বাকি সঞ্চয় দিয়ে আর কত বছর চালাতে পারবেন, তার হিসাব করেন। এমনকি তিনি তাঁর উইলও প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার দিনটির জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে একদিন, তাঁর কম্পিউটারে আচানক এমন এক বার্তা ভেসে ওঠে যে ‘শত্রু আসছে’, যা তাঁর জীবনকে অনিশ্চিত ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

পরিচালক ইয়োশিদা দাইহাচি জাপানের একজন মেধাবী সমকালীন চলচ্চিত্রকার। এর আগে তাঁর ‘পেইল মুন’ (২০১৪) টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল। তিনি ‘দ্য কিরিশিমা থিং’–এর (২০১২) জন্য জাপান একাডেমি চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা পরিচালক এবং ‘দ্য সিথিয়ান ল্যাম্ব’–এর (২০১৮) জন্য বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে কিম জি–সিওক পুরস্কার জিতেছেন। প্রায় ৩০ বছর পর ৎসুতসুই ইয়াসুতাকার ‘টেকি’ নামের মূল উপন্যাসটি দ্বিতীয়বারের মতো পাঠ দাইহাচিকে এই নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে। ৎসুতসুই ইয়াসুতাকা একজন বিখ্যাত জাপানি ঔপন্যাসিক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। তাঁর কাজ গাঢ় হাস্যরস ও ব্যঙ্গাত্মক বিষয়বস্তুর জন্য সুপরিচিত। তিনি তেন্নো ব্যবস্থা কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কোরীয় বাধ্যতামূলক যৌন সেবাদাসিদের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মনোবিশ্লেষণ ও পরাবাস্তববাদ। ‘তেকি’, অর্থাৎ ‘শত্রু’ উপন্যাসেও এ বিষয়গুলোরই দেখা মেলে।
মূল উপন্যাসের আলোকে চলচ্চিত্রটিতে একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের প্রতিদিনের দুর্বলতা ও বিড়ম্বনার দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। নিঃসঙ্গ জীবনে অতীতের নানা স্মৃতি কীভাবে বর্তমানের ওপর প্রভাব ফেলে এবং অতীত ও বর্তমানের এই দেওয়া-নেওয়া কী করে একসময় সময়কালকে একাকার করে ফেলে, তা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রকার। চলচ্চিত্রের নায়ক ফরাসি সাহিত্যের একজন সাবেক অধ্যাপক হওয়ায় প্রায়ই তাঁকে ফরাসি সাহিত্যের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিতে দেখা যায়। নিজে রান্না করে খাওয়ার অভ্যাস থাকলেও এক ফরাসি রেস্তোরাঁয় তাঁর যাতায়াত রয়েছে।

সেখানে একদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে রেস্তোরাঁমালিকের এক ভাতিজির সঙ্গে, যে কিনা নিজেকে পরিচয় দেয় ফরাসি সাহিত্যের একজন ছাত্রী হিসেবে। মেয়েটি তার পড়ার খরচ দিতে হিমশিম খাচ্ছে, এমন কথা একদিন জানতে পেরে অধ্যাপক তাকে প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার ধার দেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, মেয়েটি আসলে তাঁকে বোকা বানিয়েছে। তাঁর টাকা নিয়ে সে ও তার চাচা দোকান বন্ধ করে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। অবসর বয়সে অতিরিক্ত কিছু আয়ের জন্য অধ্যাপক এখনো একটি ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন এবং মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেকচার দেন। তিনি প্রতি লেকচারের জন্য এক লাখ ইয়েনের একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এক প্রাক্তন ছাত্র এর কারণ জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন, প্রতি মাসে সংবাদপত্রের জন্য আমাকে সাড়ে তিন হাজার ইয়েন দিতে হয়, কিন্তু প্রতি মাসে কি সাড়ে তিন হাজার ইয়েনের সমমূল্যের খবর থাকে পত্রিকায়? তাই আমার ক্ষেত্রে কেন কম টাকা দিতে হবে?

‘টেকি কামেথ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন জাপানি অভিনেতা নাগাৎসুকা কিয়োজো
ছবি: টিফ ২০২৪

এদিকে আরেক প্রাক্তন ছাত্রী তার কাছে এখনো নিয়মিত আসে বই নিতে বা নানা আলোচনার জন্য। একদিন ডিনার শেষে ছাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করে, তিনি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আগ্রহী কি না? অধ্যাপক লজ্জায় হ্যাঁ–সূচক জবাব দিলে সে তাঁকে শিগিগিরই শেষ ট্রেন ধরতে হবে বলে তাড়া দেয়। তখন পর্দায় অনেক কমিক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কিন্তু পরে দেখা যায়, পুরোটাই ছিল অধ্যাপকের স্বপ্ন এবং পুরো বিষয় নিয়েই তিনি বিব্রত। তবে এই দৃশ্য প্রবীণ বয়সেও স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অবদমিত জাগতিক চাহিদার ইঙ্গিত দেয়, যে বাস্তবতা নিয়ে সমাজে আলোচনা অত্যন্ত বিরল। চলচ্চিত্রের শেষের দিকে অবশ্য এ স্বপ্ন আর বাস্তবতা একাকার হয়ে যায়।

কখনো দেখা যায়, ছাত্রীর জন্য ডিনার প্রস্তুত আর ডাইনিং টেবিলে এসে দেখেন, তাঁর স্ত্রী সেখানে বসে আছেন। তিনি ছাত্রীকে সব খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রকাশনা সংস্থার এক কর্মী এসে উপস্থিত। মৃত ও জীবিত ব্যক্তি একসঙ্গে দীর্ঘ সময় নিয়ে নানা আলোচনায় সম্পন্ন করেন নৈশভোজ। এর মধ্যে শত্রুরা দলবদ্ধভাবে হামলা চালায় টোকিওতে এবং তাঁর বাড়িতে।

শুরুতে শত্রু আসে উত্তর দিক থেকে, এটি সম্ভবত রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার রেফারেন্স। এরপর জানা যায়, শত্রু আসছে দক্ষিণ দিক থেকেও, যেটি হয়তো চীনের দিকে দিক নির্দেশ করে। শত্রুরা আর কেউ নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে শরণার্থী। কিন্তু পরে দেখা যায়, বিভিন্ন গোলা এসে পড়ছে শহরে এবং অধ্যাপকের বাড়িতে। এ  রকম চরম উত্তেজনাপূর্ণ সময়েও থাকে হাসির খোরাক। দেখা যায়, শত্রুর মারাত্মক আক্রমণের মুখে সবাই যখন একেক দিকে পালাচ্ছেন, তখন এক নারীর হাত থেকে তাঁর কুকুর ছুটে পালিয়ে গেলে তিনি চিৎকার করে ওঠেন ‘বালযাক...বালযাক’ বলে। কুকুরের এই নামকরণ বলাবাহুল্য বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক অনোরে দি বালযাকের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যা গল্পের এ রকম ক্রান্তিলগ্নেও কমেডির খোরাক জোগায়। শত্রুর বিষয়ে পরিচালক দাইহাচির ভাষ্য হচ্ছে যে মানুষকে নিজের জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এ ধরনের কাল্পনিক শত্রু তৈরি করে নিতে হয়। এটি অনেকটা জীবনকে একটি উদ্দেশ্য প্রদান করে বা অর্থবহ করে তোলে।

সাদা–কালোয় এই চলচ্চিত্রের সেট হচ্ছে মূল চরিত্রের বাসভবন। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাড়িতে বাস করেন তিনি। তাই এতে অন্যান্য জাপানি চলচ্চিত্রের অনেক রেফারেন্স পাওয়া যায়। যেমন একদিকে রয়েছে ক্ল্যাসিক্যাল নির্মাতা ওজু ইয়াসুজিরোর চলচ্চিত্রের প্রভাব, তেমনি সমকালীন নির্মাতা হিরোকাজু কোরে-এদার ‘স্টিল ওয়াকিং’ কিংবা ‘আওয়ার লিটল সিস্টার’–এর অন্তর্দৃশ্যের কথাও স্মরণে আসে। কীভাবে জাপানি বাড়িগুলো ক্ল্যাসিক্যাল ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছিল, দাইহাচিও নির্মাণের আগে সেটি পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানান উৎসবের এক আলাপচারিতায়। আর এ কারণেই তিনি চলচ্চিত্রটি সাদা–কালোয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এই চলচ্চিত্রের নায়ক খুব অন্তর্মুখী এক চরিত্র, অন্তর্দৃশ্যের সেটিং তাঁর এই অবদমিত ইচ্ছাগুলোকে বের করে আনতে সাহায্য করে বলে পরিচালকের বিশ্বাস। তাঁর মতে, এটি দর্শকদের তাঁদের কল্পনাকে আরও বেশি ব্যবহারে প্ররোচিত করে। একটি সীমিত স্থান থেকে গল্পের জগৎকে প্রসারিত করার কাজটি কঠিন হলেও তিনি স্থানিক এই চাপের মধ্যে এগোতে পছন্দ করেন, যে চাপ শেষ পর্যন্ত কাহিনির অন্তে ন্যারেটিভের কাঠামো বা আবেগকে এর চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

সর্বোপরি, এই চলচ্চিত্র জাপানের ক্রমে বেড়ে চলা বয়োবৃদ্ধ সমাজের এক করুণ চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রটির মতো অনেক চরিত্র এভাবে স্বপ্ন-বাস্তবতা আর স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝখানে নিয়ত যাপন করছেন তাঁদের জীবন এবং লড়ে যাচ্ছেন সময় ও ক্রমবর্ধমান একাকিত্বের সঙ্গে। জুরি প্রেসিডেন্ট হংকংয়ের বিখ্যাত অভিনেতা টনি লিউং টোকিও গ্রাঁ প্রি পুরস্কার দেওয়ার সময় বলেন, ‘আমরা সবাই এমন একটি চলচ্চিত্র দ্বারা গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছি, যা সাহসী আন্তরিকতা, গভীর প্রজ্ঞা এবং জীবনের কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অসাধারণ ধারালো হাস্যরসের মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছে, যেগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই লড়াই করলেও এ নিয়ে কথা বলা এড়িয়ে যাই। এটি ছিল বিশুদ্ধতম এবং সর্বোৎকৃষ্ট বাস্তব ঘরানার এক চলচ্চিত্র: চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা ও অভিনয় এর মিনিমালিস্ট সেটিংকে অত্যন্ত জটিল এবং বহুস্তরের করে তোলে।’ এদিকে সেরা পরিচালক ও সেরা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি এই চলচ্চিত্রে ওয়াতানাবে গিসুকে নামে মূল চরিত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে উৎসবের সেরা অভিনেতার পুরস্কারও জিতে নিয়েছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা নাগাৎসুকা কিয়োজো। একসময় প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা কিয়োজোর চলচ্চিত্রের নায়কের মতোই ফরাসি সাহিত্য নিয়ে গভীর জ্ঞান থাকায় মাঝেমধ্যেই ফরাসি সাহিত্যিক কিংবা খাবারের রেফারেন্স টানার বিষয়গুলো তাঁর জন্য সহজ হয়েছে। জুরি প্রেসিডেন্ট টনি লিউংয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘যে মুহূর্ত থেকে তিনি পর্দায় পা রেখেছিলেন, তিনি তাঁর গভীরতা এবং বাস্তব অভিনয় দিয়ে আমাদের বিমোহিত করেছিলেন।’

একাকিত্বের লড়াই থেকে যাওয়া যাক সামগ্রিক লড়াইয়ে। উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছে কলম্বিয়ার চলচ্চিত্র স্প্যানিশ ভাষার ছবি ‘আদিওস আমিগো’ (স্প্যানিশ নাম ‘আদিওস আল আমিগো’)। স্যান্টান্ডারভিত্তিক পরিচালক ইভান ডি গাওনা রচিত ও পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়েছে ১৯০২ সালে ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত কলম্বিয়ায় তিন বছরের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময়কে ঘিরে। উদারপন্থী সৈনিক আলফ্রেডো স্যান্টান্ডারের চিকামোচা ক্যানিয়নে যান তাঁর নিখোঁজ সৈনিক ভাইকে এটি জানাতে যে তাঁর সন্তানের জন্ম হয়েছে। পথে ঘটনাক্রমে অপেশাদার ফটোগ্রাফার বেনিতোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, যিনি যুদ্ধকালে তাঁর বাবাকে হত্যাকারী এক ব্যক্তিকে খুঁজছেন। দুজন একসঙ্গে ভ্রমণ করার সময় নানাজনের মুখোমুখি হন তাঁরা এবং ঘটনার নানা ঘূর্ণিপাকে মুখোমুখি হন একে অন্যের।

৩৭তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পোস্টার

‘আদিওস আমিগো’ হচ্ছে একটি স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন (যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্মিত ওয়েস্টার্ন) এবং অ্যাকশননির্ভর চলচ্চিত্র, যা গৃহযুদ্ধের শেষে কলম্বিয়ার পাহাড়ে নানা বিশৃঙ্খলাকে চিত্রিত করে। যুদ্ধ, বন্ধুত্ব, শ্রেণিবৈষম্য ও উপনিবেশবাদ—এ রকম বিভিন্ন থিমকে মিশ্রিত করে একটি চমৎকার বিনোদনমূলক নাটকীয় চলচ্চিত্র এটি। দেশের ইতিহাস ও স্বজাতির শিকড়কে প্রকাশ করতে গিয়ে পরিচালক ইভান ডি গাওনা বেছে নেন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের ধরন, যার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছে ছোটবেলায় পিতার হাত ধরে। ওয়াইড লেন্স ও লং শটে অনবদ্য যে প্রকৃতির দেখা চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়, তা মূলত তাঁর নিজ শহর স্যান্টান্ডারেরই। অন্যদিকে এই ভূদৃশ্যগুলো যেন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের জন্যই তৈরি হয়ে আছে এবং চলচ্চিত্রের কাহিনি তুলে ধরায় যথাযথ অবস্থান হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। অনেক সংঘাত ও লড়াই এতে চিত্রিত হলেও শেষ পর্যন্ত এটি যেন একটি যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র, যা আমাদের চলমান বাস্তবতায় শান্তির গুরুত্বকেই তুলে ধরে। এতে বেনিতোর সেকালের বিশালাকারের ক্যামেরা সেলফ-রেফ্লেকটিভ অনুঘটক হিসেবে চলচ্চিত্রের ক্যামেরার কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি এডসন ভ্যালেন্ডিয়ার জুতসই কিন্তু উচ্চকিত সংগীতায়োজন ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ কিংবা ‘দ্য সার্চার’–এর মতো ক্ল্যাসিক্যাল হলিউডি ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের প্রতি হোমেজ হিসেবেই পরিগণিত করা যায়। তবে পার্থক্য রয়েছে দুই ঘরানার মধ্যে।

যেমন চলচ্চিত্রে একদল আদিবাসী মার্কিনকে দেখা যায়, যারা রেড ইন্ডিয়ানদের মতোই তির–ধনুক নিয়ে বন্দুকের সঙ্গে মোকাবিলা করে, কিন্তু তাদের দলনেতার ব্যবহৃত রহস্যময় এক গুঁড়া এই চলচ্চিত্রকে বাস্তবতা থেকে পরাবাস্তবতায় নিয়ে যায়। শত্রুদের মুখে ছুড়ে দেওয়া সেই গুঁড়া তাদের নিক্ষেপ করে স্বপ্নের এক জগতে, যেখানে তারা অতীত বা ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়, লড়াই করে, আবার বাস্তবতায় ফিরে আসে কিছু সময় পর, যখন তাদের ভেতরে জাগ্রত হয় ভিন্ন ইতিবাচক চেতনার। এই দিকটি আলোচ্য চলচ্চিত্রের একেবারে নিজস্ব ভাষা বলেই মনে হয়। তবে ধনী-গরিবের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের একটি চিত্রায়ণও ফুটে ওঠে এই নির্মাণে। আলফ্রেডো ও বেনিতোদের গরিব বিদ্রোহী সেনাদের একটি দলে এক অভিজাত তার অধীন লোকজনকে নিয়ে ভিড়ে গিয়ে নিজেকে গরিবদরদি ও দাসবিরোধী উদারপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করে এবং তাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু একদিন সে নিজের শারীরিক দুর্বলতার কথা বলে সেই দলের অভিযান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় কিন্তু যাওয়ার সময় দলটির হাতে বিশেষ কারণে থাকা কিছু স্বর্ণমুদ্রার থলে চুরি করে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে তার দরিদ্র কর্মচারী সেটি জানতে পেরে তাকে পরিত্যাগ করে এবং সেই মুদ্রা আবারও আলফ্রেডোদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এতে বোঝা যায়, যতই চেষ্টা করুক না, শ্রেণির প্রশ্নে ধনী আর গরিবের ফারাক কখনো ঘোচে না। তবে এ ধরনের উপাদান, এর অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শক্তিশালী অভিনয় শুধু দর্শকদেরই নয়, জুরিদেরও মন ভরিয়েছে। জুরি সদস্য জাপানি অভিনেত্রী হাশিমোতো আই যেমন বলেছেন, গৃহযুদ্ধ শেষের কলম্বিয়ার প্রেক্ষাপটে নির্মিত কল্পনাত্মক ও হাস্যরসাত্মক ভাবের মিশেলে এগিয়ে যাওয়া কাহিনিটি ছিল বিস্ময়ে পূর্ণ এবং পরিচালকের অনন্য শৈলী ছিল মনোমুগ্ধকর। তাঁর ভাষায়, ‘একটি জোরালো ঝড়ের সময় পেছনে রংধনুকে রেখে মূল নারী চরিত্রের তারস্বরে চিৎকার করার দৃশ্যটি সিনেমার ইতিহাসে একটি কিংবদন্তি শট হয়ে উঠবে।’ যা–ই হোক, গৃহযুদ্ধ থেকে এখন নজর দেওয়া যাক করুণ এক জীবনযুদ্ধের দিকে।

এবারের উৎসবের অন্যতম একটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র ছিল চীনের মেধাবী ফিকশন ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা ইয়াং লিনা নির্মিত ‘বিগ ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশাল বিশ্ব’। এতে একজন প্রতিবন্ধী যুবকের জীবনসংগ্রামকে অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত চুনহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় তাঁর নানির দলের মঞ্চনাটকে সাহায্য করেন। নানি তাঁকে বিভিন্ন সামাজিক আয়োজনে জড়ানোর চেষ্টা করলেও তাঁকে নিয়ে তাঁর মায়ের দুশ্চিন্তা থামে না। অত্যন্ত মানবিক এই চলচ্চিত্রে শারীরিক-মানসিক নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়াদের গল্প অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাদের সংগ্রাম, স্বপ্ন আর ভালোবাসা এবং সর্বোপরি লড়াই পরিস্ফুট হয়েছে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত এক তরুণের মধ্য দিয়ে।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত, যার মধ্যে শুধু চীনেই রয়েছেন ৬০ লাখ। তাই কীভাবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাঁদের চাকরির ক্ষেত্রে, জীবনে তাঁদের পছন্দের ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, সেটিকে চিত্রিত করার কঠিন কাজটি হাতে নেন পরিচালক লিনা। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো এক তরুণ কীভাবে প্রতিটি দিন অতিক্রম করেন, তাঁর স্বপ্নের পেছনে ছোটেন, আর দশজনের মতো প্রেমে পড়েন, কর্মক্ষেত্রে সামাজিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন এবং তা সত্ত্বেও অদম্য স্পৃহা নিয়ে এগিয়ে যান, সেই নিদারুণ বাস্তবতা উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে। তথ্যচিত্রে সিদ্ধহস্ত লিনা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবেই নির্মাণ করেছেন এই গল্প। তাঁর মতে, ‘শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা তাকে একজন মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছি। কারণ, দিন শেষে সে অন্যদের থেকে আলাদা কেউ নয়। এই চলচ্চিত্রে দুটি দৃশ্য মনে দাগ কাটার মতো।

নানির দলের ড্রাম বাজানোর প্রচেষ্টায় পর্যুদস্ত চুনহে যখন এক তরুণীর সহানুভূতিময় সঙ্গ পেয়ে তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে ফেলে এবং একদিন হাঁটতে হাঁটতে প্রবল আবেগে মেয়েটির হাত ধরতে চান। সুন্দরী ও মমতাপূর্ণ সেই বান্ধবী তখন নিদারুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এবং হাতটি ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যায়। এ সময় দুজনের মুখের অসাধারণ বেদনাময় অভিব্যক্তিতে দর্শকের হৃদয় নিংড়ে যায়। অন্য দৃশ্যটি হলো, কাহিনির শেষাংশে যেদিন চুনহে তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমোদনসূচক চিঠি হাতে পায়, সে মুহূর্তে এত দিনের সংগ্রাম, গ্লানি কিংবা শারীরিক যন্ত্রণা—সব ছাপিয়ে চুনহে ও তার নানির আপ্লুত হওয়ার দৃশ্য যেকোনো দর্শককেই ছুঁয়ে যাবে।’ চলচ্চিত্রের তিনটি প্রদর্শনীতেই পরিপূর্ণ ছিল মিলনায়তন এবং চুনহে চরিত্রে জ্যাকসন ইর বিশ্বাসযোগ্য ও অনুপ্রেরণাদায়ক অভিনয় এতটাই অনবদ্য ছিল যে যৌক্তিকভাবেই উৎসবের অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড বা দর্শকদের ভোটে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয় ছবিটি। টিফের চেয়ারম্যান আন্দো হিরোইয়াসুর মতে, ‘এই অভিনেতার অভিনয় ছিল বাস্তবিকই বিস্ময়কর।’ এ ছাড়া নানির ভূমিকায় ডায়ানা লিনও ছিলেন অনবদ্য। এই চলচ্চিত্রে সংগীতায়োজন করেছেন জাপানের নন্দিত সংগীত পরিচালক কোবাইয়াশি তাকেশি।
এবার নজর বোলানো যাক উৎসবের অন্যান্য আয়োজনের দিকে। (পরের পর্বে)