জনগণকে রেখে পালিয়ে গেলেন স্বৈরশাসক, এরপর...
খাবার নেই। রাস্তায় বের হলে অভুক্ত শিশুদের দিকে তাকানো যায় না। তবে রাজার সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ভাবছেন নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের কথা। সেই রাজা, যিনি বাইরের শত্রুর আক্রমণের সময় দেশের জনগণকে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অবধারিতভাবেই তার রাজপ্রাসাদ লুট হয়, পুড়ে ছাই হয় প্রতিশোধের আগুনে। রাজা পালিয়ে বাঁচেন, তবে তার দম্ভ যায় না। অনেক কারণেই গল্পটা আপনার চেনা মনে হতে পারে। তবে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক প্রসঙ্গের অবতারণা নেটফ্লিক্সের সিনেমা ‘আপরাইজিং’-এর কারণে। ১১ অক্টোবর প্ল্যাটফর্মটিতে মুক্তির পর থেকেই প্রশংসায় ভাসছে সিনেমাটি। কেউ সিনেমাটির তারিফ করছেন এর শিল্পমানের জন্য, কেউ আবার চমকে গেছেন সমসাময়িক অনেক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলে যাওয়ায়।
‘আপরাইজিং’
পরিচালক: কিম সাং-ম্যান
অভিনয়ে: গ্যাং ডং-উন ও পার্ক জেয়ং-মিন
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
কোরিয়ার জোসন সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক ওয়ার অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ‘আপরাইজিং’। এটি বানিয়েছেন কিম সাং-ম্যান। এর দুই চিত্রনাট্যকারের একজন পার্ক চান-উক, ছবির অন্যতম প্রযোজকও তিনি; এ তথ্য ছবিটি নিয়ে আপনার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। কোরিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই পরিচালক তাঁর ‘ভেনজেন্স’ ত্রয়ীর জন্য পরিচিত। চিত্রনাট্যকার হিসেবে যুক্ত থাকলেও ‘আপরাইজিং’ সিনেমায় চান-উককে ভালোভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়।
চেওন ইয়েং (গ্যাং ডং-উন) ও লি জং (পার্ক জেয়ং-মিন) সমবয়সী। পার্থক্য একটাই যে একজন ক্রীতদাস, অন্যজন প্রভাবশালী জমিদারের সন্তান। চেওন ছোট থেকেই দুর্দান্ত লড়াকু আর লি লড়াইয়ে আনাড়ি। ক্রীতদাস চেওনই প্রভু লিকে লড়তে শেখায়। দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব তৈরি হয়। একই প্রাসাদের আলাদা জায়গায় বড় হতে থাকে দুজন। লড়াইয়ের দক্ষতার কারণে অনেক জায়গায়ই লির বদলে পাঠানো হয় চেওনকে। ক্রীতদাস হলেও লির সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে প্রভাবশালী ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে চেওন। তবে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে একসময়। কেন, সে প্রশ্নের উত্তর জানার আগে ঘটে আরেক ঘটনা।
১৫৯২ সালে কোরিয়া আক্রমণ করে জাপান। ফলে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন রাজা। সাধারণ জনগণকে নিয়ে এক বিদ্রোহী দল গঠন করে চেওন। আর রাজার সবচেয়ে আস্থাভাজন যোদ্ধা হয় লি। ফলে রাজা তথা লি আর চেওন একপর্যায়ে হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। কে জিতবে শেষ পর্যন্ত? লি আর চেওনের বন্ধুত্ব কি জোড়া লাগবে? এমন অনেক প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে যায় গল্প।
রাজা আর প্রজা সমান, কেবল এই কথা বলার ‘অপরাধে’ নির্বিচার খুন হয় সাধারণ মানুষ। এমনকি লড়াই-প্রশিক্ষণে জমিদারের সন্তানকে হারানোর ‘অপরাধে’ও মার খায় ক্রীতদাস। বেশির ভাগই মারা পড়ে। পরদিন হাজির হয় নতুন আরেক ক্রীতদাস। দিনের পর দিন বঞ্চনা সইতে সইতে ক্রীতদাসেরা যখন জেগে ওঠে, তখন রাজার কী হাল হয়, ছবিতে তা-ও আছে। আপরাইজিং দিয়ে মূলত শ্রেণিবৈষম্যের সমাজব্যবস্থাকে থাপ্পড় মেরেছেন পরিচালক।
জাপান একসময় কোরিয়া আক্রমণ করেছিল এটা যেমন সত্য, তেমনই অনেক কোরীয় সিনেমায় বিষয়টিকে একতরফাভাবে দেখানো হয়েছে, এটাও সত্য। ‘আপরাইজিং’-এও এসেছে এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। তবে নির্মাতা দেখিয়েছেন, বাইরের দেশ নয়, বরং স্বদেশের স্বৈরশাসকই কখনো কখনো দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে। অহংবোধ, বিলাসিতা, দম্ভ আর জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করলে সেই দেশ আর স্বৈরশাসকের কী পরিণতি হতে পারে, সিনেমায় সেটা উঠে এসেছে। ‘আপরাইজিং’ ছবিতে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে নিজের সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে রাজা নির্বিচার সাধারণ জনগণকে মেরে ফেলতে বলছেন! কারণ, তার কাছে জনগণ নয়, বরং যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই বড়।
শ্রেণিবৈষম্য আর রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া কেবল অ্যাকশনের জন্যও ‘আপরাইজিং’ দেখা যায়। ছবিতে তলোয়ারযুদ্ধের কোরিওগ্রাফি যেভাবে করা হয়েছে, অনেক দিন সেটা মনে থাকবে। পার্ক চান-উক অ্যাকশন দৃশ্যের ওস্তাদ, তাঁর ওল্ডবয় সিনেমার করিডর অ্যাকশন দৃশ্য পরের বহু সিনেমাকে প্রভাবিত করেছে। এ ছবিতেও আছে মনে রাখার মতো তেমন একটা অ্যাকশন দৃশ্য।
ক্লাইম্যাক্সে তিনজনের একটি দীর্ঘ অ্যাকশন দৃশ্য রয়েছে, যা চলতি বছর তো বটেই; সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যেই অন্যতম সেরা। সমুদ্রের পাড়ে চিত্রায়িত দৃশ্যটিতে কুয়াশা, আলো-অন্ধকার আর তলোয়ারযুদ্ধ দিয়ে অদ্ভুত এক দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন নির্মাতা।
দুর্দান্ত সব দৃশ্যকল্প, সংলাপ আর অ্যাকশনের সঙ্গে ছবিটির বড় প্রাপ্তি হাস্যরস। ডার্ক হিউমারের জন্য পার্ক চান-উকের খ্যাতি আছে, এ সিনেমায়ও তা ভালোমতোই বজায় রেখেছেন তিনি। মাঝপথে ছবি কিছুটা গতি হারালেও মোটের ওপর দারুণ উপভোগ্য ‘আপরাইজিং’। কাকতালীয়ভাবে সাম্প্রতিক নানা বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকায় ১২৬ মিনিটের ছবিটি একটানা দেখতে একটুও বিরক্ত লাগবে না। তবে সিনেমাটিতে বেশ কয়েকটি সহিংস অ্যাকশন দৃশ্য রয়েছে, এ ধরনের দৃশ্য দেখতে যাঁরা অস্বস্তি বোধ করেন, সিনেমাটি তাঁদের এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
অনেক রাজনৈতিক বক্তব্য থাকলেও ‘আপরাইজিং’ শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বেরই গল্প। ছোটবেলা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত লি আর চেওনের বন্ধুত্বেরই জয়গান গেয়েছে ছবিটি। চেওন চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন গ্যাং ডং-উন। এ সিনেমা দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর পর নির্মাণে ফিরলেন কিম সাং-ম্যান। সেটাও হলো ফেরার মতো ফেরা।