ইতালির রাজপুত্রের ১০০ বছর
সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেতা তিনি। ফেদেরিকো ফেলিনি আর সোফিয়া লরেনের সঙ্গে তাঁর জুটি উপহার দিয়েছে অবিশ্বাস্য সব সিনেমা। আজ সেই মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নির জন্মশতবর্ষ। প্রখ্যাত এই ইতালীয় অভিনেতার জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ারে আলো ফেলেছেন লতিফুল হক
হেলিকপ্টার উড়ছে। দড়িতে ঝুলছে যিশুর মূর্তি। রোমের আকাশ সচকিত হয়ে ওঠে। একেকজন একেকভাবে দেখে ব্যাপারটা, ছাদে রোদ পোহাতে থাকা নারীরা বিস্মিত হয়। সবাই তাকায় ঊর্ধ্বমুখে, দেখে দুহাত মোড়া পাথুরে ‘যিশু’ দুলছে! হেলিকপ্টারে দেখা মেলে এক সুদর্শন পুরুষের। চেঁচিয়ে ফোন নম্বর চায় সুন্দরীদের। কেউ কিছু শোনে না। শুনতে পায় না। ছবির সাউন্ডট্র্যাকে শুধু হেলিকপ্টারের ডানার শব্দ। মুক্তির পর আট দশকের বেশি পেরিয়ে গেছে, তবু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘লা দোলচে ভিতা’র এ দৃশ্য মনে রেখেছেন সিনেমাপ্রেমীরা, মনে রেখেছেন হেলিকপ্টার থেকে উঁকি দেওয়া সেই অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নিকেও।
একনজরে মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নি
জন্ম: ২৮ সেপ্টেম্বর, ইতালি
চলচ্চিত্র অভিষেক: ১৯৩৯
আন্তর্জাতিক খ্যাতি: ‘লা দোলচে ভিতা’, ১৯৬০
প্রিয় জুটি: সোফিয়া লরেনের সঙ্গে ১৪টি সিনেমা
পুরস্কার: ভেনিস ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে দুবার করে সেরা অভিনেতা, তিন অস্কার মনোনয়ন
স্ত্রী: ফ্লোরা ক্যারাবেল্লা (১৯৫০-১৯৬৪)
মৃত্যু: ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৬, ফ্রান্স
১৪ বছরে শুরু
১৯২৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির এক গ্রাম ফনতানা লিরিতে জন্ম মার্সেলোর। বড় হয়েছেন তুরিন আর রোমে। মা ছিলেন টাইপিস্ট, বাবা আসবাব মেরামতের কাজ করতেন। মঞ্চ আর সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন মার্সেলো। ১৯৩৪ সালে তাঁকে প্রথম দেখা যায় মারিওনেত্তে সিনেমায়। বয়স তখন মোটে ১৪, সে সিনেমার ক্রেডিটে অবশ্য নাম ছিল না তাঁর।
১৯৪৬ সালে রোসেলিনির ‘পাইসা’ ছবিতে চিত্রনাট্যকার হিসেবে সুযোগ পান প্রখ্যাত নির্মাতা ফেদেরিকো ফেলিনি। সেই সময়ই মার্সেলোর সঙ্গে ফেলিনির প্রথম মোলাকাত। মার্সেলো তখন থিয়েটারের এক তরুণ অভিনেতা। সিনেমা করার স্বপ্নে বিভোর ফেলিনিও। তাঁদের একসঙ্গে চলার সেই শুরু; বাস্তব, অবাস্তব, স্মৃতি থেকে কল্পনার প্যালেটে রং মেশানোর শুরু বোধ হয়।
ট্যাবলয়েড সাংবাদিক
মার্সেলো প্রথমবার সিনেমায় বড় চরিত্র পান ১৯৫১ সালে ‘আত্তো ডি’আকুসা’য়। এরপর অস্কার মনোনীত ‘বিগ ডিল অন ম্যাডোনা স্ট্রিট’ সিনেমা দিয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে ওঠা ফেলিনির হাত ধরে, ‘লা দোলচে ভিতা’ সিনেমা দিয়ে। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি মার্সেলোর ক্যারিয়ারের গতিপথই বদলে দেয়। এক ট্যাবলয়েড সাংবাদিকের চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেন। তিন বছর পর মুক্তি পায় ‘এইট অ্যান্ড হাফ’, এটিও ফেলিনির সিনেমা। এবার এক চলচ্চিত্র পরিচালকের চরিত্র। অল্প সময়ের মধ্যে ভিন্নধর্মী দুই চরিত্রে নিজের অভিনয়ক্ষমতার প্রমাণ দেন মার্সেলো।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ‘বিগ ডিল অন ম্যাডোনা স্ট্রিট’, ‘হোয়াইট নাইটস’-এর মতো রোমান্টিক সিনেমা করেছেন, তখনকার সময়ের অন্যতম ‘আবেদনময় অভিনেতা’র তকমাও পেয়েছিলেন। পরে নিজের এই ইমেজ ভেঙে খলনায়ক হিসেবেও পর্দায় হাজির হয়েছিলেন।
ফেলিনি ও অন্যরা
নিজের সময়ের সেরা ইতালীয় নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন মার্সেলো। তাঁদের মধ্যে ফেলিনি ছাড়াও আছেন মাউরো বোলোনিনি (‘হ্যান্ডসাম আন্তোনিও’), মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি (‘দ্য নাইট’), পিয়েত্রো জারনি (‘ডিভোর্স ইতালিয়ান স্টাইল’), তাভিয়ানি ভ্রাতৃদ্বয় (‘আলোনসানফান), মার্কো বেল্লোসিও (‘হেনরি ফোর’)। পরে জন বোরম্যান, থিও অ্যাঞ্জেলোপোলাস, রোমান পোলানস্কি, রবার্ট অল্টম্যান, নিকিতা মিখাইলকভ, মারিয়া লুসিয়া বামবার্গসহ অনেক ইউরোপীয় ও মার্কিন নির্মাতা এসে মার্সেলোর দরজায় কড়া নাড়েন। তবে ফেলিনির সঙ্গে তাঁর পর্দার জুটি সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে। এ তথ্য আজ অনেকেরই জানা, লা দোলচে ভিতা সিনেমায় ফেলিনি মার্সেলোকে নিয়েছিলেন প্রযোজকদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। তাঁদের প্রথম পছন্দ ছিলেন পল নিউম্যান। পরে মার্সেলো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর চেহারা খুব ‘সাধারণ’ বলেই ফেলিনি তাঁকে পছন্দ করেছিলেন। ইতালীয় সাংবাদিক এলাইন এলকানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফেলিনি সম্পর্কে মার্সেলো বলেছিলেন, ‘শিল্পীদের জন্য তিনি ছিলেন দারুণ এক দার্শনিক। তাঁর সঙ্গে কাজ করা নন-স্টপ পার্টির মতোই অভিজ্ঞতা। যেখানে মজা হয়, চাইলে বিরতি নেওয়া যায়; সব মিলিয়ে দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।’
ইতালীয় সিনেমার রাজা-রানি
মার্সেলোর কথা লিখতে গেলে ফেলিনির কথা যেমন আসবে, অবধারিতভাবে আসবে সোফিয়া লরেনের কথাও। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ১৭০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মার্সেলো, এর মধ্যে সোফিয়া লরেনের সঙ্গেই করেছেন ১৪টি। কাকতালীয়ভাবে তাঁদের জন্মদিনও এক সপ্তাহের ব্যবধানে। মার্সেলো ও লরেনকে বলা হয় ইতালীয় সিনেমার ‘রাজা-রানি’। তাঁদের উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে আছে ‘দ্য অ্যানাটমি অব লাভ’, ‘ব্লাড ফিউড’, ‘গোস্টস, ইতালিয়ান স্টাইল’, ‘দ্য প্রিস্টস ওয়াইফ’, ‘গান মোল’ ইত্যাদি।
‘ওর সঙ্গে সিনেমার প্রস্তাব পেলে চিত্রনাট্য না পড়েই রাজি হয়ে যেতাম। কারণ, আমি জানি তার সঙ্গে কাজ করলে সবকিছু ঠিকঠাকমতোই হবে। সে যেমন আমাকে চিনত, আমিও তাকে চিনতাম। তার হাস্যরস, ইম্প্রোভাইজেশন শুটিংকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেত।’ কাইটেরিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্সেলো সম্পর্কে বলেন সোফিয়া লরেন।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পুরস্কার, সম্মাননা কম পাননি মার্সেলো; তবে তিনবার মনোনয়ন পেয়েও অস্কার না পাওয়ায় তাঁর ভক্তদের মধ্যে একধরনের আক্ষেপ আছে। অস্কার না পেলেও ভেনিস ও কান উৎসবে দুবার করে পাওয়া সেরা অভিনেতার পুরস্কার মার্সেলোর জাত চিনিয়েছে। কানে দুবার করে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাওয়া তিন অভিনেতার একজন তিনি।
অনেক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন মার্সেলো, তবে বিয়ে করেছিলেন একবারই। ১৯৫০ সালে বিয়ে করেন ইতালীয় অভিনেত্রী ফ্লোরা ক্যারাবেল্লাকে, সে সম্পর্ক টিকেছিল ১৪ বছর। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ফরাসি অভিনেত্রী ক্যাথেরিন দ্যনোভের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। তাঁদের সন্তান অভিনেত্রী কিয়াগা মাস্ত্রোয়ান্নি।
মার্সেলোর জীবনী নিয়ে নির্মিত সবচেয়ে প্রশংসিত তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন আন্না মারিও তাতে। ‘মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নি: আই রিমেম্বার’ মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। আন্না ১৯৭৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মার্সেলোর সঙ্গী ছিলেন।
না থেকে মার্সেলো ছিলেন চলতি বছর কান উৎসবেও। গত ২১ মে উৎসবে প্রিমিয়ার হয় ‘মার্সেলো মিও’ সিনেমার। এক গ্রীষ্মে মার্সেলোর কন্যা ঠিক করেন, তিনি তাঁর বাবার মতো জীবন যাপন করবেন। এরপরই তিনি মার্সেলোর মতো পোশাক পরে কথা বলেন! এমন গল্পের সিনেমায় মার্সেলোর স্ত্রী ও কন্যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর বাস্তব জীবনের প্রেমিকা কাত্রিন ক্যাথেরিন ও কন্যা কিয়াগা মাস্ত্রোয়ান্নি।
ফ্রান্সের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল মার্সেলোর। কানে দুবার সেরা অভিনেতার পুরস্কার ছাড়াও উৎসবে ১১ বার তাঁর সিনেমা মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সেই ফ্রান্সেই মৃত্যু হয় মার্সেলোর।