কান চলচ্চিত্র উৎসবে কী হয়

উৎসব মিলনায়তনের দেয়ালে অফিশিয়াল পোস্টার, এবারের উৎসবের পোস্টার তৈরি করা হয়েছে আকিরা কুরাসাওয়ার `র‌্যাপসোডি ইন আগস্ট' অবলম্বনে। ছবি: রয়টার্স

চলচ্চিত্রশিল্পের অন্যতম বড় প্রদর্শনীর নাম কান চলচ্চিত্র উৎসব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত নবীন-প্রবীণ অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলীদের আড্ডায় মুখর থাকে এ উৎসব। কানে চাইলে যে কেউ চলচ্চিত্র জমা দিতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনের প্রতিনিধিদের সেটা দেখার সম্ভাবনা থাকে। ভালো লেগে গেলে নতুন নির্মাতাদের জন্য মিলে যেতে পারে বিনিয়োগ। কোয়েন্টিন টারান্টিনো, স্টিভেন সডারবার্গের মতো পরিচালকের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে। চলুন আমরা জানার চেষ্টা করি, কখন, কীভাবে কান চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে এবং এখানে কী কী ঘটে।

শুরু
বিখ্যাত লেখক ফিলিপ্পে এরল্যাঙ্গার ১৯৩৮ সালে প্রথম কান উৎসব আয়োজনের ধারণা দেন। ১৯৩৯ সালে হওয়ার কথা ছিল প্রথম আসর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পরিবেশ পেরিয়ে ১৯৪৬ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে বসে প্রথম আসর। আসরের সেরা পুরস্কার ‘পাম দি’অর’ বা ‘স্বর্ণপাম’ প্রথম প্রদান করা হয় ১৯৫৫ সালে। সুইস জুয়েলারি কোম্পানি চোপার্ড ১৯৯৭ সালে পুরস্কারটিকে আধুনিকীকরণ করে। এতে বসানো হয় ২৪ ক্যারেটের সোনা ও ক্রিস্টাল।

১২ দিনের উৎসব
ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শহর কানে বসে চলচ্চিত্রজগতের সবচেয়ে সম্মানজনক এ আসর। প্রতিবছরের মে মাসে ১২ দিনের জন্য বসে এ আসর। এবার বসছে কানের ৭৭তম আসর। ১৪ মে শুরু হয়ে চলবে ২৫ মে পর্যন্ত।

`দ্য সেকেন্ড অ্যাক্ট' সিনেমার দৃশ্য। ছবিটি দিয়েই শুরু হচ্ছে এবারের উৎসব। আইএমডিবি

১৯৪৬ সালে শুরুর পর থেকে প্রতিবছর সেরা চলচ্চিত্রকে পুরস্কৃত করা হয়। এটি বিশ্বের চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও প্রযোজকদের অন্যতম একটি মিলনমেলা। এটি বিশেষভাবে পরিচিত পাম দি’অর পুরস্কারের জন্য, যা দেওয়া হয় মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রকে। প্যালেস অব ফেস্টিভ্যালে বসে প্রতিযোগিতা বিভাগের আসর।

সিনেমা নির্বাচন
প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার সিনেমা জমা পড়ে এবং সিলেকশন কমিটি প্রতিটি সিনেমা দেখে। সেখান থেকে ৫৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ও ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা অফিশিয়াল সিলেকশনের জন্য নির্বাচন করে। কানের মূল আসরে মূলত এই ৭০টি সিনেমাই প্রদর্শন করানো হয়।

অফিশিয়াল সিলেকশনের জন্য যে সিনেমাগুলো নির্বাচন করা হয়, সেগুলো বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়: ১. কম্পিটিশিন: ফিচার ফিল্মস অ্যান্ড শর্টফিল্মস; ২. ফিচার ফিল্মস আউট অব কম্পিটিশন; ৩. আঁ সার্ত্রে রিগা; ৪. সিনেফনডেশন।
একটি সিনেমা প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। মূল প্রতিযোগিতা, আউট অব কম্পিটিশিন কিংবা আঁ সার্ত্রে রিগা—যে বিভাগেই হোক না কেন, এটা অবশ্যই উৎসবে জমা দেওয়ার অন্তত ১২ মাসের মধ্যে নির্মিত হতে হবে। সিনেমাটি কোনো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে, এমনকি যে দেশে তৈরি হচ্ছে, সেই দেশেও প্রদর্শন করানো যাবে না। পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকলেও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ১৫ মিনিটের বেশি হতে পারবে না।

আউট অব কম্পিটিশন বিভাগে যেসব সিনেমা প্রদর্শিত হয়, সেগুলো কান সিলেকশন কমিটি নির্বাচন করে দিলেও প্রতিযোগিতার মানদণ্ড মেনে চলার ব্যাপারে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

আঁ সার্ত্রে রিগায় প্রদর্শিত সিনেমাগুলো নির্মাতার প্রথম সিনেমা হতে হয় এবং এর মাধ্যমে নির্মাতার পরীক্ষামূলক কৌশল ও প্রগতিশীল ভাবনা ফুটে ওঠে।
১৯৯৮ সালে চালু হয় সিনেফনডেশন বিভাগ। এ বিভাগে বিশ্বের চলচ্চিত্র স্কুলের ছাত্ররা তাঁদের সিনেমা জমা দিতে পারেন। এখানে প্রদর্শিত সিনেমাগুলো মূলত কল্পকাহিনি, বাস্তবতানির্ভর কিংবা অ্যানিমেশনধর্মী হতে হয়। দৈর্ঘ্য হতে হবে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা।
জুরি

কানের অফিশিয়াল জুরি দুই ভাগে বিভক্ত—দ্য ফিচার ফিল্মস জুরি ও দ্য শর্টফিল্মস অ্যান্ড সিনেফনডেশন জুরি। গোপন ব্যালটে ভোট হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিয়ম অনুসরণ করা হয়। জুরি সদস্য যাঁরা থাকেন, প্রতিযোগিতায় তাঁদের কোনো সিনেমা থাকতে পারে না।

জুরি সদস্য নির্বাচন করা হয় সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে। অফিশিয়াল জুরি করা হয় সাম্প্রতিক কালে চলচ্চিত্রজগতে যাঁরা নিজেদের কাজ দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন, তাঁদের। জুরিবোর্ডের সদস্য হতে পারা খুবই সম্মানজনক একটি ব্যাপার। প্রধান জুরি হতে পারাটা আরও বেশি সম্মানের।

গ্রেটা গারউইগ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

এবারের উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান জুরি মার্কিন অভিনেত্রী ও পরিচালক গ্রেটা গারউইগ। অন্যরা হলেন মার্কিন অভিনেত্রী লিলি গ্ল্যাডস্টোন, ফরাসি অভিনেত্রী ইভা গ্রিন, ফরাসি অভিনেত্রী ওমর সাই, টার্কিশ চিত্রনাট্যকার ও আলোকচিত্রী ইবরু সেলান, লেবাননের অভিনেত্রী ও নির্মাতা নাদিন লাবাকি, স্প্যানিশ নির্মাতা হুয়ান আন্তোনিও বায়োনা, ইতালীয় অভিনেতা পিয়েফ্রানসেস্কো ফ্যাভিনো ও জাপানি নির্মাতা কোরে-এডা হিরোকাজু। অন্যদিকে এবার উৎসবের ক্রিটিকস উইক শাখার প্রধান জুরির দায়িত্ব পালন করছেন স্প্যানিশ পরিচালক রুদ্রিগো সরোগয়েন।

বাংলাদেশি জুরি
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জুরি হিসেবে রেড কার্পেটে হেঁটেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু। ৭৫তম আসরে তিনি এই অনন্য সম্মাননা পান।

এ বছর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সমালোচক ও চিত্রনাট্যকার সাদিয়া খালিদ রীতি ফিপ্রেসকি (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস) জুরি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। ২০১৯ সালেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ মুজতবা জামাল ফিপরেস্কির বিচারক ছিলেন। তাঁকে ২০০৫ ও ২০০৯ সালেও ফিপরেস্কির বিচারকের আসনে দেখা গেছে।

বাংলাদেশি সিনেমা
২০২২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ভারতীয় প্যাভিলিয়নে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটির ট্রেলার প্রদর্শিত হয়।
২০২১ সালে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ জায়গা করে নেয় আঁ সার্ত্রে রিগা বিভাগে। এটিই ছিল কানের কোনো প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রথম কোনো সিনেমার জায়গা পাওয়ার ঘটনা।
২০১৬ সালে কান ক্লাসিকস বিভাগে খান আতাউর রহমানের উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ প্রদর্শিত হয়। ১৯৫৮ নির্মিত সিনেমাটি বাংলাদেশে চিত্রায়িত।
২০০২ সালে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশ থেকে কানে অংশ নেয়। এটি ফিপরেস্কিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়।

একনজরে
১. এটি ২০০২ সাল থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসব নামে পরিচিতি পায়। এর আগে এটি পরিচিত ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ নামে।
২. এ পর্যন্ত চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ৮০ হাজার মানুষ কানে আমন্ত্রিত হয়েছেন।
৩. বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪ হাজার সাংবাদিক কানে আমন্ত্রিত হয়েছেন।
৪. ৫০০০ সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছে এবং ২০০ সিনেমা পাম দি’অর বা স্বর্ণপামের জন্য লড়াই করেছে।
৫. স্বর্ণপামের অর্থমূল্য প্রায় ২৬ লাখ টাকা।
৬. কানের লালগালিচা ১৮০ মিটার বিস্তৃত।
৭. ৮৯টি দেশ কানের প্রতিনিধিত্ব করে।
৮. প্রতিবছর কানের আয়োজন সম্পন্ন করতে ১ হাজার মানুষ কাজ করেন।
তথ্যসূত্র: কান অফিশিয়াল সাইট, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, কোতে দি আ’জুর, মাসিক উত্তরণ