৫২টা চাকরি ছেড়েছেন, বউ তাঁকে ছেড়েছিল, তবু তিনি অভিনয় ছাড়েননি
চাকরিতে যোগদানের আগেই তিনি প্রতিষ্ঠানকে খোলাসা করতেন, তাঁর অভিনয়ের নেশা আছে। মাঝেমধ্যে শুটিংয়ের জন্য ছুটি দরকার হবে। যোগদানের আগে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বলত, দেখা যাবে। পরে ঘটত বিপত্তি। শুটিংয়ের কথা বলে ছুটি নিলে কোনো প্রতিষ্ঠান এক সপ্তাহ, কেউ ১৫ দিন বা এক মাসের পর ছাঁটাই করত। একমাত্র অভিনয়ের কারণেই একে একে ৫২টি চাকরি খোয়াতে হয়েছে ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পী গোলাম ফারুক যুবরাজকে। শুধু তাই নয়। বারবার এই অভিনেতাকে অভিনয় ছাড়তে বলেও লাভ হয়নি স্ত্রী জয়নব খাতুনের। পরে স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও অভিনয় ছাড়েননি তিনি।
তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। এখন থাকেন পাবনা শহরে। শুটিংয়ের ডাক পড়লে সেখান থেকে ছুটতে হয় ঢাকাসহ সারা দেশে। বেশির ভাগ সহ-অভিনেতা হিসেবেই তাঁকে পর্দায় দেখা যায়। অভিনয়ের জন্য নিয়মিত নির্মাতা ও শুটিং ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। নিয়মিত যোগাযোগ রাখার কারণে অনেক নির্মাতাই তাঁকে মোবাইলের কালোতালিকায় রেখেছেন। যুবরাজ বলেন, ‘কাউকে এসএমএস করতাম, কাউকে ফোনে বলতাম, আমার অভিনয়ের ইচ্ছা আছে কিছু কাজ করেছি। আপনারা আমাকে একটু সুযোগ দিলে খুশি হতাম। নির্মাতারা যোগাযোগ রাখতে বলতেন। এক সপ্তাহ বা পনেরো দিন পরে আবার মনে করিয়ে দিতাম। এই জন্য অনেকই বিরক্ত হয়ে ব্লক করেছেন। আবার কেউ টাকা চাইতেন। কেউ অপমান করে বলতেন ফোন না দিতে।’
তাঁর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মে ২০০০ সাল–পরবর্তী। তখন তিনি সিরাজগঞ্জ থাকতেন। একবার সিরাজগঞ্জ শিল্পকলায় গিয়ে দেখেন, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অভিনয়শিল্পী জাহিদ হাসান ও আলীরাজ। খুব কাছে থেকে তাঁদের কথা শুনলেন। সেদিনই তিনি অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। কেন সেদিন মনে হয়েছিল আপনাকে অভিনেতা হতে হবে? তিনি বলেন, ‘সেদিন জাহিদ হাসান ও আলীরাজ ভাইয়ের মুখে শুনলাম, একজন অভিনেতা সমাজবদলে অনেক ভূমিকা রাখতে পারেন। অভিনেতারা কখনো অসৎ হন না। তাঁদের দিয়ে সমাজের খারাপ কাজ হয় না। তাঁরা দেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করেন। তাঁরা সুস্থ বিনোদন নিয়ে কাজ করেন। তাঁরাও দেশের সম্পদ। দেশের মানুষ অভিনয়শিল্পীদের ভালোবাসেন। এমন খ্যাতি সবার ভাগ্যে জোটে না। কথাগুলো আমার ভালো লেগে যায়। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই অভিনয় করব।’ পরে জাহিদ হাসানের থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন। অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম ২০০৫ সালে প্রথম ‘লাইন নম্বর-৩’ নাটকে অভিনয় করেন। চিত্রগ্রাহক চাচা আনোয়ার হোসেন বুলু বিটিভির এ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
এমনও অনেকবার হয়েছে, শুটিং এসে শুনলেন একদিন পরে কেউ শিডিউল চান বা পরের দিন সকালে শুটিং। তখন তিনি থাকার জায়গা নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। তখন পাবনা যাওয়া–আসার খরচ ও সময়ের কথা চিন্তা করে রাত পার করেন রাস্তায়।
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ঘন ঘন চা খেয়ে দোকানে রাতটা কাটাই। এভাবে সারা রাত জেগে সকালে শুটিংবাড়িতে গিয়ে কিছুটা ঘুমানোর সুযোগ হয়। তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। কারণ, ঢাকায় আমার তেমন পরিচিত কেউ নেই। দু-একজন থাকলেও কতবার তাঁর বাসায় থাকা যায়। এ জন্য বাইরে বা রাস্তায় থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভিনয়ের জন্য কোনো কিছুকেই কষ্ট মনে হয় না।’
মাসে বড়জোর ১০ দিন শুটিংয়ের ডাক পান। সেই আয় দিয়ে সংসারের খরচ চলে না। তারপরে করোনার পর থেকে কাজ কমে গেছে। আবার ঢাকার বাইরে থাকেন শুনেই অনেক নির্মাতা শুটিংয়ে নিতে চান না। এ জন্যই তিনি বাড়তি আয়ের জন্য চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘চাকরিতে নেওয়ার পরে অফিস থেকে চাপ দিত অভিনয় ছেড়ে দিতে। এ নিয়ে গালাগাল করত। অনেককে বলতাম অর্ধেক মাসের বেতন দিলে চলবে। কেউই শুনত না।’ গত বছর দুটি চাকরি ছাড়তে হয়েছে। সর্বশেষ শাকিব খানের ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমায় শুটিংয়ের জন্য তাঁর চাকরি যায়। সিনেমায় তাঁর ১০ দিনের শুটিং করার কথা ছিল। অফিসের ফাঁকে ফাঁকে শুটিংয়ের জন্য ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন। ফলাফল, চাকরি নট। পরে সেই সিনেমায় এক দিনের শুটিংয়ে তাঁর ডাক পড়েছিল। তিনি বলেন, ‘স্থায়ীভাবে কিছু চাকরি পেয়েছিলাম। কিন্তু অভিনয়ের জন্য করিনি। অভিনয় আর সংগ্রাম করেই জীবনটা চালিয়ে নিব। মন যেটা চায় সেটাই করব। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।’
ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স করেছেন। মাস্টার্স করা হয়নি। আর্থিক সংকট ছিল। সংসারে অভাব–অনটন নিত্যসঙ্গী। অন্যদিকে এলাকার অনেকেই তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁদের চরিত্র ভালো নয়। যুবরাজেরও চরিত্র ভালো নয়। ‘আয়রোজগার, অভিনয়ে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আমার স্ত্রী বলেছিলেন, হয় অভিনয় ছাড়তে হবে, নয় তাঁকে ছাড়তে হবে। আমি নিরুত্তর ছিলাম। স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। ছয় মাস পরে পরিবারের সবাই তাকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় ফিরিয়ে আনেন। আমার কোনো উপায় নেই জানি। কিন্তু অভিনয় ছাড়তে পারি না। গত দুই ঈদে চলার কোনো টাকাই ছিল না। বাচ্চার দুধ কেনার টাকাও মাঝেমধ্যে থাকে না। আমি কষ্ট করছি পরিবার নিয়ে ভালো থাকার আশায়।’ তাঁর অভাবের কথা শুনে পাবনা-৫ আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক পাবনার একটি কলেজে রাতে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখান থেকে প্রতিদিন ২০০ টাকা পান। জানালেন, তাঁর স্ত্রী ভালো গান করেন। তিনি এক ওস্তাদের কাছে গান শিখছেন অন্যদের শেখানোর জন্য। অভিনয়পাগল স্বামীর জন্যই তিনিও সংসারের আয়ে অবদান রাখতে চেষ্টা করছেন।
যুবরাজকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন হুমায়ুন ফরিদী। এই কিংবদন্তি অভিনেতার পরিচালনায় একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন যুবরাজ। ‘সেই সময় হুমায়ুন ফরিদী স্যার আমার অভিনয়ের প্রশংসা করে বলেছিলেন, যুবরাজ তুমি হচ্ছ আলু। তোমাকে সকল তরকারিতে ব্যবহার করা যায়। তুমি চাচা, মামা, ভাই, বয়স্ক, তরুণ, বোকা, চালাক, ভিলেন সকল চরিত্রেই মানান সই। স্যারের কথায় সেদিন অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস কখনোই কেউ আমাকে ভালো চরিত্রে ডাকলেন না। আমার ইচ্ছা অভিনয়ের যুবরাজ হয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া’।—বললেন যুবরাজ।
মামুনুর রশীদের লেখা ‘জিন্দাবাহার’ ‘বকুলপুর’, ‘ছায়া বিবি’, ‘ডিবি’, ‘ক্রাইম পেট্রল’, ‘চান বিরিয়ানি’, ‘গোলমাল’সহ বেশ কিছু ধারাবাহিকে অভিনয় করছেন। সম্প্রতি শেষ করেছেন ‘কাগজ’ সিনেমা’ ‘ঈশা খাঁ’ এবং ‘আবার’ ওয়েব ফিল্মের কাজ। তিনি অভিনয়শিল্পী সংঘ এবং চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য।