সেবার পুরো শুটিংয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সঙ্গে কথাই বলেননি
রসিক মানুষ ছিলেন অভিনয়শিল্পী সালেহ আহমেদ। শুটিংয়ের সারাক্ষণ সহকর্মীদের হাসিয়ে মাতিয়ে রাখতেন। অন্যের রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়তেন। স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ সালেহ আহমেদের রসিকতায় না হেসে পারতেন না। আবার হুমায়ূন আহমেদের রসিকতাতেও তিনি হেসে গড়িয়ে পড়তেন। তাঁদের রসায়নটা ছিল দারুণ। কিন্তু একবার ঘটে গেল ভিন্ন ঘটনা। সেবার পুরো শুটিংয়ের সময় হুমায়ূন আহমেদ এই অভিনেতার রসিকতায় হাসেননি এবং তাঁকে হাসতে দেননি। এমনকি তাঁর প্রিয় সালেহ ভাইয়ের সঙ্গে কথাও বলেননি।
হাসিখুশি এই প্রবীণ মানুষটাকে শুটিংয়ে দেখলে মনে হতো তিনি শিশু। সব সময় খুশিতে মেতে থাকতেন তিনি। রাগ, মান–অভিমান, এগুলো হয়তো তাঁর জীবনের অভিধানে লেখা ছিল না। সালেহ আহমদে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আবার হয়ে যেতেন নরম মাটির মতো। মুহূর্তেই নিজেকে ভাঙতে পারতেন। যেকোনো চরিত্রে নির্মাতারা তাঁর অভিনয়কে কাদামাটির মতো ব্যবহার করতেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রে সাবলীল অভিনয়ই সেই স্বাক্ষর রাখত। শক্তিমান এই অভিনেতাকে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে।
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে দারোয়ানে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সালেহ আহমেদ। সেই থেকে তাঁর ওপর পাকাপাকি আস্থা তৈরি হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের। তারপর থেকে এই অভিনেতাকে যেকোনো চরিত্রের জন্য ভাবতেন হুমায়ূন আহমেদ। এই নির্মাতা তখন প্রথম সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’র কলাকুশলী চূড়ান্তের কাজে ব্যস্ত। গল্পে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ছিল ঢাকাইয়া পানের দোকানদার। এই চরিত্রের জন্য বয়স্ক একজন মানুষের দরকার ছিল। এ জন্য তিনি সালেহ আহমেদেকে চূড়ান্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই দাঁড়ি রাখতেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে বলেছিলেন এক মাসের দাঁড়ি রাখতে। মুখভর্তি দাঁড়ি রাখলে গল্পের জন্য ভালো হবে। সেভাবেই পরিচালক চরিত্রের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেন। কিন্তু শুটিংয়ের দিন দেখা গেল হাসিমুখে ক্লিন সেভ করে হাজির সালেহ আহমেদ। আর তাতে রেগে আগুন হয়ে যান হুমায়ূন আহমেদ।
শেভ করা অবস্থায় সালেহ আহমেদকে দেখে হুমায়ূন আহমেদের চোখ ছানাবড়া। সালেহ আহমেদ সেদিন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, মেকআপম্যান নকল দাঁড়ি লাগিয়ে দেবেন। সেই দাঁড়ি লাগানো নিয়ে অনেক চেষ্টা করা হলো। কোনো নকল দাঁড়িই হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করলেন না। অগত্যা দাঁড়ি ছাড়াই শুরু হয় শুটিং। হুমায়ূন আহমেদের গলায় কই মাছের কাটার মতো বিঁধে রইল এই দাড়ির ব্যাপারটা। শুটিংয়ের পুরোটা সময় হুমায়ূন আহমেদ দাঁড়ির ব্যাপারটা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। মেজাজ খারাপ ছিল তাঁর। তবে সব ছাপিয়ে সিনেমায় সালেহ আহমেদের অভিনয় খুবই চমৎকার হয়েছিল। হুমায়ূন আহমদে যা চেয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি পেয়েছিলেন।
সেই শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে সালেহ আহমেদ ক্রমাগত নানা রকম রসিকতা করছেন। শুনে সবাই হো হো করে হেসেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ইচ্ছা করেই কোনো কথায় হাসা তো দূরে থাক, তাঁর দিকে সেভাবে তাকানওনি। এমনকি তাঁর নিজের কোনো কথায় যেন সালেহ আহমেদ না হাসেন, সে জন্যও তিনি সতর্ক ছিলেন। ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার অভিজ্ঞতাকে ঘিরে লেখা ‘ছবি বানানোর গল্প’ বইয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘“আগুনের পরশমণি”র পুরো শুটিংয়ের পুরো সময় সালেহ ভাইয়ের একটি রসিকতাতেও আমি হাসিনি। আমার রসিকাতাতেও তিনি হাসার কোনো সুযোগ পানিনি। কেননা, তিনি যখন আমার আশপাশে থাকতেন, তখন আমি জটিল বিষয়, যেমন নন্দনতত্ত্ব, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, গ্রিনহাউস ইফেক্ট—এসব নিয়ে কথা বলতাম। আর তাঁর দিকে তাকাতাম না।’
সালেহ আহমেদ ছিলেন হুমায়ূন আহমদের নাটক ও সিনেমার নিয়মিত অভিনয়শিল্পী। দীর্ঘদিন তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কখনোই কোনো রকম দূরত্ব তৈরি হয়নি। ‘আগুনের পরশমণি’ শুটিংয়ের সময়ের ঘটনা ছিল হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছাকৃত। তাঁর সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সালেহ আহমেদ আমার অতি প্রিয়জন। সদাচঞ্চল, হাসিখুশি একজন মানুষ। “আগুনের পরশমণি” সিনেমায় তাঁর অংশটি নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। আমি জানতাম, তাঁর অংশটি তিনি চমৎকারভাবেই করবেন।’
প্রয়াত হওয়ার কয়েক বছর আগেই সালেহ আহমেদ বার্ধক্যজনিত নানান রোগে ভুগছিলেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। অসুস্থতা তখন থেকে তাঁর পিছু ছাড়েনি। কিছুদিন ভালো থাকেন, আবার খারাপ হয়ে যান। এর পাশাপাশি ফুসফুসে প্রদাহ, কিডনির সমস্যাসহ আরও নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
সালেহ আহমেদের জন্ম বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চাকরির পাশাপাশি ময়মনসিংহে অমরাবতী নাটমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৯১ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেছিলেন। ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়’ এবং ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয়জগতে তাঁর দুই পর্দায়ই পদচারণ শুরু। এরপর অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। গতকাল ২৪ এপ্রিল ছিল তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।