নৃত্যাঙ্গন পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান

সম্প্রতি নারী পাচারের দায়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ারকে। এ ঘটনায় নৃত্যাঙ্গন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে শিল্পীদের; মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে নৃত্যাঙ্গনে। তাঁদের দাবি, নারী পাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি পরিচ্ছন্ন নৃত্যাঙ্গন।

মুনমুন আহমেদ, শামীম আরা নীপা, শিবলী মহম্মদ, ওয়ার্দা রিহাবকোলাজ

‘অবহেলা’ যেন নৃত্যশিল্পীদের পায়ে–পায়ে বেজেছে ঘুঙুরের মতোই। যে সম্মান, সমাদর ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে বিনোদনের অন্য প্রায় প্রতিটি মাধ্যম, নৃত্য তা পায়নি। এই অনাদর নিয়েই নৃত্যশিল্পীরা তাঁদের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। গুরুমুখী এ বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি তাঁদের অনেকেই দেশ–বিদেশ থেকে অর্জন করছেন উচ্চতর ডিগ্রি। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তবু শেষ হচ্ছে না তাঁদের।

সম্প্রতি নারী পাচারের দায়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ারকে। এ ঘটনায় নৃত্যাঙ্গন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে শিল্পীদের; মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে নৃত্যাঙ্গনে। তাঁদের দাবি, নারী পাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি পরিচ্ছন্ন নৃত্যাঙ্গন।

শাস্ত্রীয় নৃত্যের শিল্পীরা সমাজে বিশেষভাবে সম্মান পেয়ে আসছেন
সংগৃহীত

একুশে পদক পাওয়া নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা মনে করেন, সততার সঙ্গে সঠিক পথে সাধনা করে গেলে কোনো শিল্পী বিপদগ্রস্ত হতে পারেন না। অন্যথায় কারও একক ভুল বা লোভের কারণে পুরো অঙ্গন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা নাচের প্রয়োজনীয় জায়গা পেতাম না, অনুষ্ঠান পেতাম না। প্রায়ই নিজেদের ব্যর্থ মনে হতো। কিন্তু এখন মনে হয়, আমরা আসলে সঠিক পথেই ছিলাম, আছি। আমাদের সান্ত্বনা একটাই, মানুষ আমাদের শ্রদ্ধা করে। আমরা সৎ পথে থাকতে চেষ্টা করি, ছাত্রছাত্রীদেরও রাখার চেষ্টা করি। সবাইকে পরামর্শ দেব, তাঁরাও যেন সৎ থাকেন।’

তারকা নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ মনে করেন, অভিভাবকদের উচিত সঠিক গুরুর হাতে সন্তানদের তুলে দেওয়া। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর সাধনা করে যাওয়া শাস্ত্রীয় নৃত্যের শিল্পীরা চলচ্চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান ও মঞ্চে যতটা না জায়গা পেয়েছেন, এর চেয়ে বেশি পেয়েছেন জনপ্রিয় ধারার একদল শিল্পী। কেন কীভাবে পেয়েছেন, এখন এই প্রশ্ন তুলব না। শুধু বলব, অতি লোভের ফল কখনো ভালো হয় না। নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি নৃত্যাঙ্গন গড়ে তুলতে হলে নারী পাচারের মতো অপরাধীদের শাস্তি হতে হবে।’

নারী পাচারের মতো ঘটনাগুলোয় নৃত্যশিল্পীদের নাম কেন আসছে? নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ মনে করেন, নাচ নিয়ে লেখাপড়া বা অধ্যবসায় ছাড়াই যাঁরা আধুনিক নাচ করেন, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ও বেশি অর্থ রোজগারের লোভে তাঁদের অনেকে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়তে পারেন। এ ধরনের প্রলোভনে সাড়া দেওয়াই উচিত হয়নি তাঁদের। তিনি বলেন, ‘ইভান যদি এ রকম কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে, তাহলে খুব অন্যায় করেছে। আবার কেউ তাকে ফাঁসিয়েছে কি না, সেটাও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, এ ধরনের অপরাধ করে কেউ যেন পার না পায়, আবার বিনা দোষে কেউ যেন শাস্তি না পায়, সেটা লক্ষ রাখা দরকার।

তরুণ শিল্পীরাও নিজেদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন
সংগৃহীত

অভিযোগ উঠেছে, নৃত্যাঙ্গনের কেউ কেউ মানব পাচারের মতো কাণ্ডে জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু সেসব নিয়ে এই অঙ্গনের জ্যেষ্ঠরা তেমন তৎপরতা দেখাচ্ছেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক শিল্পী। তাঁদের অন্যতম নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব বলেন, ‘নাচকে আমরা সম্মানজনক একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। মানব পাচারের দু–একটি ঘটনা আমাদের সেই প্রচেষ্টায় কালি লেপে দিতে পারে। সঠিক উপায়ে নিয়ম মেনে আমরা যারা বিদেশে অনুষ্ঠান করতে যাই, তাদের সুযোগগুলো ভবিষ্যতে নষ্ট হতে পারে। অল্প সময়ে বেশি টাকা রোজগারের লোভে যারা এই অঙ্গনকে কলুষিত করছে, নারী পাচারের মতো খারাপ কাজে জড়াচ্ছে, তাদের দমন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নাট্য ও নৃত্যাঙ্গনের জ্যেষ্ঠ অনেকেই এ বিষয়গুলো জানেন। জানি না কেন সম্ভাব্য অপরাধীদের ব্যাপারে তাঁরা মুখ বুজে আছেন।’

নৃত্যশিল্পীদের অনেকেই জানিয়েছেন, আধুনিক ঘরানার নাচের সঙ্গে যুক্ত তরুণ–তরুণীদের নানা রকম প্রলোভন দেখানো হয়। সেসবের মধ্যে থাকে বিদেশ ভ্রমণ, অস্বাভাবিক পারিশ্রমিক, অনুষ্ঠান পাইয়ে দেওয়া। বেশির ভাগ শিল্পী এসব লোভ সংবরণ করে নিজেদের চর্চা চালিয়ে যান। তবে অনেকেই লোভে পড়ে পা বাড়ান অন্ধকার পথে। অনেকেই পা ফসকে বিপথগামী হন, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে অনেকে দেখিয়েছেন ইভান শাহরিয়ারকে।