তাঁর বাড়ির দরজা আমাদের জন্য সব সময় খোলা থাকত

সেই ১৯৬৭ সাল থেকে একসঙ্গে নাট্যচর্চা, টেলিভিশন নাটকে অভিনয়; বিভিন্ন আন্দোলনেও তাঁরা সহযাত্রী। ৫৪ বছরের সেই সম্পর্কে ছেদ পড়ল। প্রিয় ইনাম ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করলেন আবুল হায়াত

ইনামুল হক

সেই ১৯৬৭, ’৬৮, ’৬৯ থেকে একসঙ্গে আমরা। আমি, ইনাম ভাই, আতাউর রহমান, জিয়া হায়দাররা ছিলাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সেখান থেকেই শুরু। ’৭০ ও ’৭১ সালের উত্তাল সময়ে পথেঘাটে, বাংলা একাডেমিতে—কোথায় না নাটক করেছি আমরা। ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সংসদের হয়ে ট্রাকে, মঞ্চে কত যে বিপ্লবের নাটকে অভিনয় করেছি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের শোগুলো একসঙ্গে করে গেছি। আমার অত্যন্ত আপনজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ইনাম ভাই—আমি একজন আপনজনকে হারালাম।
রূপগঞ্জ থেকে গাড়িতে ঢাকায় ফেরার পথে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাই। তারপর মুঠোফোনে তাঁর ছবি খুঁজছিলাম। একটি ছবি পেলাম, ১৯৬৯ সালের। তখন ইকবাল হলের মাঠে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলাম, বিপ্লবী পুলিশের চরিত্রে। তখন তো প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে নাটক করেছি। কখনো আবার মহসিন হলের মাঠে, জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে, টিএসসিতে—একের পর এক নাটকে অভিনয় করেছি। এদিকে তো দেশে আন্দোলন চলছিল। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার আন্দোলন। একই সঙ্গে চলছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনও। তখনকার সাথি আমরা।

লাকী ইনাম ও ইনামুল হক
ছবি: সংগৃহীত
ইনামুল হকের পুরো পরিবারই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তাঁর স্ত্রী লাকী ইনাম নাট্যজগতেরই মানুষ। তাঁদের সংসারে দুই মেয়ে—হৃদি হক আর প্রৈতি হক। হৃদি হক অভিনয় এবং নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। দুই জামাতা—অভিনেতা লিটু আনাম ও সাজু খাদেম
ছবি : সংগৃহীত

একটা পরিবার সংস্কৃতিকে কতটা ভালোবাসতে পারে, তা ইনাম ভাইয়ের পরিবারকে দেখলেই বোঝা যায়। লাকী ভাবি যে রকম, হৃদি হকও তেমনি সাংঘাতিক নাটকপাগল। সাজু খাদেম আছে, আমাদের লিটু আনামও আছে, প্রৈতী আছে—পুরো পরিবারই সংস্কৃতিমনস্ক, এমনটা দেখা যায় না। তবে ইনাম ভাই কখনোই সংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করার ব্যাপারটি পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেননি। তাঁর বাড়িতে এ পরিবেশই তিনি তৈরি করেছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৬৮-৬৯ সালে আমরা যখন রিহার্সাল করতাম, নাগরিক ছাড়াও বিপ্লবের নাটকগুলোও ইনাম ভাইয়ের বাড়িতেই করতাম। ইনাম ভাই তখন ব্যাচেলরস কোয়ার্টারে থাকতেন। সেই বাড়িতে আমরা রিহার্সাল করতাম। তাঁর বাড়ির দরজা আমাদের জন্য সব সময় খোলা থাকত। ইডিপাস–এর রিহার্সাল তাঁর বাড়িতেই করেছি। এগুলো তো ভালোবাসা থেকেই হয়।

ইনামুল হক
ছবি : সংগৃহীত

শিক্ষক হিসেবে ইনাম ভাই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক জ্ঞানী–গুণী মানুষ আছেন কিন্তু ভালো শিক্ষক হওয়া খুব কঠিন। বিশেষ করে ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক হওয়াটা তো অনেক বড় ব্যাপার, সেখানে ইনাম ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। শিক্ষার্থীরা ইনাম ভাই বলতেই অজ্ঞান ছিলেন। পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সময় ব্যয় করতেন। বিদেশি সাহিত্য পড়তেন, অনুবাদ করতেন। রেডিও আর টেলিভিশনে তাঁর অনুবাদ করা নাটক হয়েছে। তাঁকে নিয়ে আসলে বলতে গেলে শেষ হবে না।
সপ্তাহ দুয়েক আগে সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে কথা হয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কী করছ? নাটকে অভিনয় শুরু করছ নাকি?’ শুরু করেছি। আপনি কী করেন? শুরু করেছেন? ‘না, আমি করিনি। আরও কিছুদিন পর বাসা থেকে বের হব। একদমই বের হইনি করোনায়।’ এরপর বললেন, ‘আমি একটা বড় কাজ করে ফেলেছি। অনেকগুলো নাটক অনুবাদ করে ফেলেছি। এখন এগুলোকে প্রিন্ট করব।’ তাঁর অনুবাদও ছিল দারুণ, অনেকগুলোতে অভিনয় করেছি। আমার নির্দেশনায়ও দু-তিনটি নাটকে অভিনয় করেছেন ইনাম ভাই। আমার চোখে তো এ রকম নিবেদিত শিল্পী পাওয়া মুশকিল। তবে তাঁর নির্দেশনায় আমার কাজ করা হয়নি। এই একটা দুঃখবোধ রয়েই গেল।

শ্রুতিলিখন : মনজুর কাদের, ঢাকা