‘আপনাদের আর নির্বাচিত অভিভাবক মানি না’

গতকাল বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের ‘কথা বলতে চাই, কথা শুনতে চাই’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন অর্ধশতাধিক সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীছবি: দীপু মালাকার

অভিনয় শিল্পী সংঘের কার্যনির্বাহী পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীরা বলছেন, ‘আমরা আর আপনাদের নির্বাচিত অভিভাবক মানি না।’

গতকাল বিকেলে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের ‘কথা বলতে চাই, কথা শুনতে চাই’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা থেকে এই ঘোষণা দেন অর্ধশতাধিক সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পী।

৭ সেপ্টেম্বর সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীরা বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় অভিনয় শিল্পী সংঘের যাঁরা একটি নির্দিষ্ট শাসনকাঠামোর পক্ষে অবস্থান নিয়ে অশিল্পীসুলভ আচরণ করেছেন, তাঁদের সবাইকে পুরো জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে হবে।

আয়োজনের ফাঁকে অভিনয়শিল্পীরা
প্রথম আলো

এর জন্য অভিনয়শিল্পী সংঘকে গতকাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন সংস্কারকামী শিল্পীরা। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা না আসায় কার্যনির্বাহী পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি অনাস্থার ঘোষণা দেন তাঁরা।

সংস্কারকামী শিল্পীদের পক্ষে অভিনয়শিল্পী শরীফ সিরাজ রবীন্দ্রসরোবরে জানান, অভিনয়শিল্পী সংঘের গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ থাকার কথা নয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ (মঙ্গলবার) রাত ১২টার পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাদের নির্বাচিত অভিভাবক হিসেবে মানবো না। আমাদের গঠনতন্ত্র আপনাদের বাতিলের খাতায় ফেলেছি। বাতিল মানুষের সঙ্গে আর কথা বলতে চাই না।’

৭ সেপ্টেম্বর অভিনয় শিল্পী সংঘের কার্যনির্বাহী পরিষদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তাঁরা। আলোচনার প্রশ্নে সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসেননি অভিনয় শিল্পী সংঘের নেতারা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আলোচনায় না আসায় শিল্পী সংঘের কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন উপস্থিত শিল্পীরা। গতকাল রাত ১২টার মধ্যে পদত্যাগ করে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অভিনয়শিল্পী সংঘের সদস্যদের দায়িত্ব হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন সংস্কারকামী শিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন
ছবি: প্রথম আলো

অভিনেতা সোহেল মন্ডল বলেন, কার্যনির্বাহী পরিষদের কাছ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে অভিনয়শিল্পী সংঘের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করবেন তাঁরা।

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকারের দোসররা এই দেশে রয়ে গেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। মিডিয়া রাষ্ট্রের বাইরে কিছু না। মিডিয়াতেও এমন অনেক দোসর ছিলেন ও আছেন। নানাভাবে সুবিধা নিয়েছেন, নিজেদের জায়গা শক্ত করেছেন। তরুণরা যেভাবে মিডিয়াটাকে দেখতে চান, আমিও সেভাবেই মিডিয়াটাকে দেখতে চাই।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। বিষয়টিকে সামনে এনে অভিনয় শিল্পী সংঘের সদস্য, অভিনয়শিল্পী নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, ‘আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীরা নানান রকম কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় আমাদেরও কটু কথা হজম করতে হয়েছে। আমরা কেন হজম করব? আমি তো কোনো দলভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিলাম না। আমি ন্যায়কে ন্যায় ও অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস রাখি। আমি কারও অন্যায়ের বোঝা কেন বহন করব?’

কথা বলছেন অভিনয় শিল্পী সংঘের সদস্য, অভিনয়শিল্পী নাজিয়া হক অর্ষা
ছবি: প্রথম আলো

অর্ষার ভাষ্য, ‘এই প্রশ্নগুলো যখন আমার কাছে এসেছে, তখন আমার মনে হয়েছে, সিনিয়রদের কাছে কথা বলা দরকার। ইনডোরে একসঙ্গে বসতে চেয়েছি। আমরা কাদা ছোড়াছুড়ি করতে চাইনি। আমাদের আজ এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এটা প্রত্যাশা করি না।’

শ্যামল মাওলা বলেন, ‘আমরা আপনাদের বিপরীত পক্ষ নই। আপনাদের উন্নয়নের জন্যই কথা বলছি। আমরা কীভাবে এই পেশাকে আরও আধুনিক করা যায়, আরও কীভাবে আন্তর্জাতিক মানের হওয়া যায়, সেসব দিক নিয়ে কথা বলতে পারি না? এসব কথা বলার জন্য এই পক্ষ, ওই পক্ষ বলার কিছু নেই। আমরা একই পরিবার, একই ছাতার নিচে আসতে চাই।’

সংস্কারকামী শিল্পীদের আলাদা কোনো সংগঠন করার পরিকল্পনা নেই। অভিনয়শিল্পী সংঘেই থাকবেন তাঁরা। তবে ইতিবাচক সংস্কারের মাধ্যমে সংগঠনটিকে আরও সদস্যবান্ধব করার প্রস্তাব দেন তাঁরা।

সংস্কারের প্রস্তাবগুলো লিখিতভাবে তুলে ধরেন অভিনয়শিল্পী মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। অভিনয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির পদক্ষেপ নেওয়া, নতুন করে শিল্পীদের নাম নিবন্ধনসহ ২২টির মতো প্রস্তাব দেন তাঁরা।

কথা বলছেন শ্যামল মাওলা
ছবি: প্রথম আলো

আলোচনার শুরুতে লিখিত বক্তব্যে অভিনয়শিল্পী খায়রুল বাসার বলেন, ‘পেশাদার হওয়া শিখতে হবে আমাদের, আমাদের অরাজনৈতিক হতে শিখতে হবে। একটি শিল্পী সংগঠন কখনো রাজনৈতিক পুতুল হতে পারে না। অভিনয়শিল্পীদেরও অনেক ধরনের সংকট আছে। তাঁদের স্বার্থ, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা তখনই সম্ভব হবে, যখন পর্দার সব অভিনয়শিল্পী একটিমাত্র সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর তখনই পুরো সিস্টেম পুনর্গঠন করা সম্ভব।’

ইতিবাচক সংস্কার নিয়ে ধারণা দিয়ে খায়রুল বাসার বলেন, ‘এত দিন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউ থাকবেন না, একে বাদ দাও, ওর সঙ্গে কাজ করব না—এমন নয়।’

বিভাজনের পথ ছেড়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন খায়রুল বাসার। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সব অভিনয়শিল্পীকে এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল গেমের’ মধ্যে শিল্পীদের পেঁচিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাহলে অভিনয়কে একটি সম্মানজনক ও নিরাপদ পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে নিশ্চিন্তে।’

রবীন্দ্রসরোবরের ‘কথা বলতে চাই, কথা শুনতে চাই’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন অর্ধ শতাধিক সংস্কারকামী অভিনয়শিল্পী
ছবি: প্রথম আলো

এ আয়োজনে মনোজ প্রামাণিক, ইমতিয়াজ বর্ষণ, হাসনাত রিপন, এলিনা শাম্মী, শারমিন আঁখি, আবদুল্লাহ আল সেন্টুসহ অনেকে বক্তব্য দেন। সাবেরী আলম, এ কে আজাদ সেতুসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন সোহেল মন্ডল।

আরও পড়ুন