অভিনয়ের টানেই ঢাকা এসেছিলেন তাঁরা
জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবু, নাজনীন চুমকি, অপর্ণা ঘোষ, কচি খন্দকার, রাশেদ মামুন অপু—অভিনয়ে তাঁদের শুরুটা হয়েছিল ঢাকার বাইরে। নিজেকে মেলে ধরার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসেন। তবে ঢাকায় এসে অভিনয় শুরুর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। শুরুর দিকে কেউ নির্মাতা ও প্রযোজকের নাগাল পাননি। কেউ পেলেও অভিনয়ে অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করেছেন লম্বা সময়। হয়েছিলেন আশাহত, তবুও ছাড়েননি হাল। সব বাধা পেরিয়ে তাঁরাই এখন নিয়মিত নাটক, চলচ্চিত্রে সমানতালে অভিনয় করছেন।
কলেজে ভর্তি হয়ে অভিনয় সিরিয়াসলি শিখতে চেষ্টা করি। এই অভিনয়ের জন্য বাসায় মিথ্যা কথাও বলতে হতো। পরে মনে হয়, পরিপূর্ণ অভিনয়শিল্পী হতে হলে আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। দিনের পর দিন আমাকে সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়, কিন্তু হাল ছাড়িনি।
ছোটবেলা থেকে নাটক দেখার ঝোঁক ছিল জাহিদ হাসানের। যাত্রাপালা, গান, নাটক বা কবিতা আবৃত্তির খবর শোনামাত্রই সবার আগে গিয়ে হাজির হতেন। স্কুলে পড়ার সময় অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু। টুকটাক করতেনও। সিরাজগঞ্জ শহরে এসে কলেজে ভর্তি হয়েই ‘তরুণ সম্প্রদায় নাট্যদল’-এ যোগ দিয়ে স্বপ্নের প্রথম ধাপে পা রাখেন। বাড়িতে না জানিয়ে চলতে থাকে তাঁর অভিনয়ের চর্চা। এমনও হয়েছে, এসএসসি পরীক্ষার আগে গভীর রাতে থিয়েটারের অনুশীলন থেকে ফিরে মা-বাবাকে বলতেন, বন্ধুর বোনের বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় অভিনয়ের প্রতি টান বুঝতে পারতাম। কলেজে ভর্তি হয়ে অভিনয় সিরিয়াসলি শিখতে চেষ্টা করি। এই অভিনয়ের জন্য বাসায় মিথ্যা কথাও বলতে হতো। পরে মনে হয়, পরিপূর্ণ অভিনয়শিল্পী হতে হলে আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। দিনের পর দিন আমাকে সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়, কিন্তু হাল ছাড়িনি।’
মঞ্চে নিয়মিত কাজ করতে চাই ভেবে ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করি। সুযোগটা কোনোভাবেই হয়ে উঠছিল না। চাকরি সেই সুযোগটা করে দেয়। ঢাকায় আসার পর থিয়েটার যে করব, কোনো মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে আমার বন্ধু আজিজুল হাকিমের মাধ্যমে আরণ্যক-এ যোগ দিই
ফরিদপুরের নাট্য সংগঠন ‘টাউন থিয়েটার’-এ প্রথম অভিনয় করেন ফজলুর রহমান বাবু। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। সময়টা ১৯৭৮। কয়েক বছর এখানে নিয়মিত নাট্যচর্চা করেন। পরে কয়েকজন মিলে ‘বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠী’ নামে নাটকের দল চালু করেন। এর মধ্যে খুঁজছিলেন ঢাকায় আসার উপায়। বাবুর কাছে মনে হয়েছিল, মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়টা চালিয়ে যেতে হলে ঢাকায় যেতে হবে। কিন্তু অভিনয়ের জন্য ঢাকায় এসে থাকার মতো অবস্থা ছিল না। পরে ব্যাংকে চাকরির সুবাদে চলে আসেন ঢাকায়।
ফজলুর রহমান বাবু বলেন, ‘মঞ্চে নিয়মিত কাজ করতে চাই ভেবে ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করি। সুযোগটা কোনোভাবেই হয়ে উঠছিল না। চাকরি সেই সুযোগটা করে দেয়। ঢাকায় আসার পর থিয়েটার যে করব, কোনো মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে আমার বন্ধু আজিজুল হাকিমের মাধ্যমে আরণ্যক-এ যোগ দিই।’ এখন নাটক-চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেন ফজলুর রহমান বাবু।
২০০৩ সালে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী অপর্ণা ঘোষের অভিনয়ের প্রতি ভালো লাগা জন্মে। বাবার হাত ধরেই যুক্ত হন চট্টগ্রামের ‘নান্দিকার’ থিয়েটারে। ২০০৬ সালে অংশগ্রহণ করেন লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায়। জায়গা করে নেন শীর্ষ ১০-এ। অপর্ণা জানালেন, ২০০৭ সালের আগে কোনো নির্মাতা বা বিনোদন অঙ্গনে পরিচিত কেউ ছিল না। বিজ্ঞাপনে কাজ করার সুবাদে পরের বছর নাটকে অভিনয়ের ডাক পড়ে। অপর্ণা বললেন, ‘অভিনয়ে আমার হাতেখড়ি চট্টগ্রামে। ঢাকায় আসার পর জানতামই না অভিনয়টাই ক্যারিয়ার হবে। ভালোবেসে কাজ করে গেছি। এখনো করে যাচ্ছি।’ টেলিভিশনে অপর্ণা প্রথম অভিনয় করেন ইফতেখার আহমেদ ফাহমীর তালা নাটকে। হাউসফুল নাটকের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
কুষ্টিয়া ও নড়াইলে দীর্ঘদিন থিয়েটার করে ঢাকায় আসি। এখানে এসে অভিনয়ে সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল। তখন তুখোড় অভিনেতাদের রাজত্ব। ঘোরাঘুরি করতে গিয়েই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় না হলে এত দ্রুত অভিনয়ে সুযোগ হতো না।
১৯৭৬ সালে স্কুলের শিক্ষার্থী থাকতেই অভিনয় শুরু করেন কচি খন্দকার। পরে কুষ্টিয়াতে অনন্যা নাট্যদল গড়ে তোলেন। চাকরির সূত্রে ১৯৯১ সালে নড়াইলে গড়ে তোলেন চিত্রা থিয়েটার। ২০০১ সালে তিনি অভিনয়ের জন্য ঢাকায় আসেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ক্যারাম নাটকে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন কচি খন্দকার। তবে ঢাকার জীবনে তাঁর শুরুটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তিনি বলেন, ‘কুষ্টিয়া ও নড়াইলে দীর্ঘদিন থিয়েটার করে ঢাকায় আসি। এখানে এসে অভিনয়ে সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল। তখন তুখোড় অভিনেতাদের রাজত্ব। ঘোরাঘুরি করতে গিয়েই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় না হলে এত দ্রুত অভিনয়ে সুযোগ হতো না।’
মামুন বলেন, ‘ঢাকায় যখন আসি, পথঘাটও চিনতাম না। এই শহরটা ছিল আত্মীয়স্বজনহীন। প্রতি মুহূর্তে একা সংগ্রাম করতে হয়েছে। নতুন করে সব শিখতে হয়েছে। অনেকে গুরুত্ব দিত না। তারপরও অভিনয়ের স্বপ্ন দেখে এতটা পথ এসেছি।
মাত্র সাত বছর বয়সেই রাশেদ মামুন অপু নাটোর মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। ব্যাংকার মা-বাবার চাকরির সূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলতে থাকে তাঁর নাটকের চর্চা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার’-এ নিয়মিত হন। পড়াশোনা শেষে ২০০৪ সালে চাকরি ও মঞ্চে অভিনয়ের জন্য ঢাকায় আসেন। অপু জানান, ঢাকায় এসে অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। তবুও অভিনয় নিয়েই স্বপ্ন দেখেছেন। মামুন বলেন, ‘ঢাকায় যখন আসি, পথঘাটও চিনতাম না। এই শহরটা ছিল আত্মীয়স্বজনহীন। প্রতি মুহূর্তে একা সংগ্রাম করতে হয়েছে। নতুন করে সব শিখতে হয়েছে। অনেকে গুরুত্ব দিত না। তারপরও অভিনয়ের স্বপ্ন দেখে এতটা পথ এসেছি।’
এখন তাঁদের সবার পরিচিতি সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ঢাকায় স্থায়ী হয়েছেন কেউ কেউ। স্মৃতির জানালায় টোকা দিলে তাঁরা মনে করেন সেই দিনগুলোর কথা—অভিনয়শিল্পী হবেন বলে তাঁরা এসেছিলেন এই শহরে। এই শহর তাঁদের স্বপ্ন পূরণের সাক্ষী।