মেয়ের অস্ট্রেলিয়ার দিনগুলোর কথা ভেবে কাঁদলেন অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী
সবার চোখ আটকে গেল অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকীর দিকে। তিনি হলভর্তি দর্শকদের সামনে কাঁদছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ। তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রোজীর কান্না থামে না। অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের দুঃসময়ের দিনগুলোর ঘটনাই তাঁকে কাঁদায়। এমন অনেক সময় গিয়েছে, মেয়ে অসহায় হয়ে বিপদে সাহায্য চাইলেও দেশ থেকে কিছুই করতে পারতেন না তারকা দম্পতি রোজী ও অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। সেসব দিনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন তাঁরা।
অভিনয়শিল্পী দম্পতি শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকীর মেয়ে সানজানা খান। ডাক নাম শ্রীমা, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করতেন। অনার্স শেষ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার সময় নানা রকম ঘটনার মধ্যে পড়েছেন। রোজী সিদ্দিকী বলেন, ‘মেয়ে ক্রিমিনাল ল নিয়ে পড়াশোনার কারণে তাকে পড়াশোনায় প্রচুর সময় দিতে হতো। কখনো লাইব্রেরি ওয়ার্ক থেকে ফিরতে কিছুটা দেরি হতো। কখনো কাজ শেষে ফিরতে দেরি হতো। তখন অনেকেই তাকে ফলো করত। আপনারা জানেন, অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদের কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে পড়তে যাওয়া ছেলে–মেয়েদের অনেকেই রোষানলে পড়েছে। মেয়ের সঙ্গে ঘটা সেই দিনগুলো ছিল আমাদের জন্য অমানবিক।’
গতকাল মুক্তি পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বর্ণবাদ নিয়ে ওয়েব ফিল্ম ‘বাবা, সামওয়ানস ফলোয়িং মি।’ এটি পরিচালনা করেছেন শিহাব শাহীন। সেই গল্প বিজু নামের একটি মেয়েকে ঘিরে। যে পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে। পাশাপাশি চাকরি করে। এক রাতে কাজ শেষ করে ফিরছিল তরুণীটি। হঠাৎ তাকে অনুসরণ করে একজন অস্ট্রেলিয়ান।
গতকাল সেই ওয়েব ফিল্মটির প্রিমিয়ার দেখেছেন রোজী। সে সময় বারবার রোজী সিদ্দিকী আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা আমার পরিবারে ঘটেছে। আমার মেয়ের সঙ্গে। তখন মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করত। সেই ঘটনাটাই আমি রিলেট করেছি। মনে হচ্ছিল আমার মেয়ের বাসায় ফিরছে আর তার সঙ্গে এমন ভয়াবহ কিছু ঘটতে হচ্ছে। আর আমরা মা-বাবা হয়েও দেশ থেকে দেখে কিছুই করতে পারছি না। এই যে মেয়ের জন্য কিছু না করার যে অসহায়ত্ব, কী যন্ত্রণা, এটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। আমি ঘটনাগুলো নিতে পারছিলাম না। যে কারণে খুব কান্না পাচ্ছিল।’
অস্ট্রেলিয়ায় এই তারকা দম্পতির মেয়ে সানজানা পড়াশোনা করার সময় তিনবার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। কখনো বাসায় ফেরা বা ঘুরতে যাওয়ার সময় এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তার মধ্যে একবার ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। এমন ঘটনার সময় প্রতিবার মেয়ে তাঁকে ফোন দিতেন। রোজী বলেন, ‘ওই মুহূর্তগুলোতে আমরা যে বেঁচে ছিলাম, এটা আমাদের বড় পাওয়া ছিল। সে যখন রাতে ফিরত বা কোনো ঘটনা আঁচ করতে পারত, তখন আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে বাসায় যেত। যখন বুঝতাম মেয়ে ভয় পাচ্ছে, তখন আমরা দিশাহারা হয়ে পড়তাম। কখনো হয়তো বাসে কোথায় যাচ্ছে, সেখানে তাকে বা তাদের বন্ধুদের নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। মেয়ে বলছে, “মা দেখো, বাজে গালি দিচ্ছে।” তখন বলতাম, “ওদের সঙ্গে কথা বোলো না। তোমার বন্ধুরা কথা বলো।” চুপ থাকতে বলতাম। তাঁদের দিকে তাকাতে নিষেধ করতে বলতাম।’
তারপরও ভয় কাটত না এই দম্পতির। তাঁরা খুঁজতেন অস্ট্রেলিয়া বন্ধুবান্ধব পরিচিত কে আছেন? কাকে ফোন করলে মেয়েটাকে দেখে আসতে পারবেন। তাঁদের অনুরোধ করতেন মেয়েকে দেখে আসার জন্য। রোজী বলেন, ‘অন্ধের মতো চেষ্টা করতাম কেউ মেয়েকে সাহায্য করুক। বাইরে যারা পড়াশোনা করে, তাদের পরিবারের কম–বেশি এমন অভিজ্ঞতা সবার রয়েছে।’
ওয়েব ফিল্মের গল্পে বিজু চরিত্রের অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ অস্ট্রেলিয়ায় বিপদে পড়লে তাঁর জন্য হন্যে হয়ে সাহায্যের উদ্দেশ্যে ছুটে যান বাবা চরিত্রের অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। সেই সেলিমকেই গল্প ও বাস্তবতার সঙ্গে মেলালেন রোজী সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘সেলিম অসাধারণ অভিনয় করেছে। আমি সেলিমের অভিনয় দেখে অহংকার বোধ করছি এই লোকটা আমার স্বামী। বাস্তবে আমার মেয়ে যখনই বিপদে পড়েছে, তখন সেলিম একদম কথা বন্ধ করে দিয়েছে। সে অসুস্থ হয়ে যেত। কথা বলতে পারত না। খুব ছটফট করত। আর আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যেতাম। বসে যেতাম জায়নামাজে। আমি দিনের পর দিন কোরআন শরিফ খতম দিয়েছি। সব সময় মেয়ের জন্য দোয়া করেছি। ও যেন নিরাপদে থাকে।’
দেশ থেকে অনেকেই বাইরে পড়াশোনা করতে যান। তাঁরা প্রায়ই এমন বর্ণবাদ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন। রোজী মনে করেন, এতে সন্তানদের দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো থেকে দূরে থাকা যাবে না। পরিবার থেকে তাদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার থেকে প্রথম শ্রীমা বাইরে যায়। যে কারণে আমরা অনেক কিছু না জানার কারণে তাকে শিখিয়ে দিতে পারিনি। যারা দেশের বাইরে যেতে চায়, সেই সন্তানদের মানসিক একটা প্রস্তুতি পরিবার থেকে তৈরি করে দেওয়া দরকার। কোন ঘটনা কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটা শিখিয়ে দেওয়া দরকার। রাত, দিন বা একা থাকলে কীভাবে চলাফেরা করবে, সেগুলো জানা দরকার। এখন আমরা এগুলো বুঝি।’
বর্তমানে মেয়ে সেমা অস্ট্রেলিয়া থেকে অনার্স শেষ করে দেশে এসেছেন। তিন মাস হলো একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তিনি। রোজী জানান, তাঁদের দুই মেয়ে যে পেশায় যেতে চান, তা নিয়ে তাঁরা কখনোই বাধা দেন না। তাঁদের স্বাধীনতা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কোভিডের মধ্যে মেয়েটা দীর্ঘদিন আটকা ছিল। পরে তো দেশে আসার পর অসুস্থ হয়ে যায়। সে এখন মানসিকভাবে স্ট্যাবল। আরও পড়াশোনা করতে চায়। মেয়ে যদি পিএইচডি বা অন্য কোনো ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে যায়, সেটা নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। যে দেশে ইচ্ছা সে যাক। এই নিয়ে কোনো চাপ দিই না। আর একটা কথা, সব জায়গায় খারাপ মানুষ যেমন আছে তেমনি ভালো মানবিক গুণাবলির মানুষও আছে। পরিবার থেকে আমরা শুধু সতর্ক করতে পারি। কিন্তু বিদেশ যেতে বাধা দেওয়াটা ঠিক মনে হয় না। কারণ, প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের সবার অভিজ্ঞতা এক না।’