‘আমার যমজ সন্তান আছে বলেই মুগ্ধ হয়তো কলিজায় খোঁচাচ্ছে’
‘আমার যমজ দুই মেয়ে রয়েছে। দুজন দুজনকে ছাড়া কতটা অসহায় শিশু। একজনকে ছেড়ে কেউই বেশি সময় থাকতে পারে না। তাদের শরীর দুটি ভিন্ন হলেও মস্তিষ্ক, হৃদয়, বোধ, ভালোবাসা এতটাই এক হয় যে একজনকে ছাড়া আরেকজন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ওদের একজনকে ছাড়া আরেকজন বড়ই অসহায়। মুগ্ধহারা স্নিগ্ধর কথা ভাবতে ভাবতে আমার কানে টাপুর-টুপুরের কথা বাজছিল।’ কথাগুলো বলছিলেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী গোলাম ফরিদা ছন্দা।
এই অভিনেত্রী যমজ সন্তানের মা। দুই মেয়ে রোদেলা টাপুর ও টুপুর অভিনয় করে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে মারা যাওয়া মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছিলেন যমজ সন্তানের একজন। তাঁরা যমজ দুই ভাই। আরেকজন মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ)। যমজ সন্তানদের বড় করার অভিজ্ঞতা থেকে ছন্দা জানান, যমজদের একজন বাইরে গেলে কী সংশয়ে থাকে আরেকজন। বারবার একে অন্যকে ফোন দেয়। একজনের অভাব যমজেরাই শুধু এটা বুঝতে পারে। সেখানে একজনের না থাকাটা তো কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। দুজনের কথা কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না।
ছন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যেহেতু যমজ বাচ্চা, সেই কারণে আমার ইমোশনটা অনেক বেশি কাজ করছে। একটা যমজ বাচ্চা জন্ম দিতে মায়ের কী কষ্ট সহ্য করতে হয়, সেই বাচ্চাকে লালন-পালন করে বড় করা কতটা কঠিন, সেটা মা জানে। যমজ শিশুদের সবকিছু একদম একই রকমের হয়। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হলেও তারা এক প্রাণ। সেই জায়গা থেকে একটা ভাই যখন পানি বিলাতে গিয়ে মারা গেল, সেই কষ্ট স্নিগ্ধ কীভাবে নেবে বা কীভাবে ও কষ্টগুলো সহ্য করছে, ভাবতেই কান্না চলে আসছে। বড় হওয়ার পর একটা সন্তান যদি মারা যায়, এই শোক প্রকাশের ভাষা নেই। এগুলো অনেক কষ্টের।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুগ্ধর পানি বিলানোর ভিডিও কদিন ধরেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওতে প্রয়াত শিক্ষার্থী মুগ্ধকে দেখে চোখের পানি মোছেননি, এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। সেই ভিডিও দেখে অন্যদের মতো কেঁদেছেন ছন্দা। তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে মুগ্ধকে দেখছিলাম আর শুনছিলাম, “পানি লাগবে পানি? পানি লাগবে পানি? পানি?” শুনে অজান্তেই চোখে পানি চলে এল। ঢোক গিললাম। ছেলেটার ঘামে ভেজা শরীর আর টিয়ার শেলের কারণে তখনো ঠিকমতো চোখ খুলতে পারছিল না। তবু সে সবার জন্য পানি দিয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধ নিঃসন্দেহে একটা অসাধারণ মানবিকতা দিয়ে গেল আমাদের।’
পানি বিলানোর ঠিক ১৫ মিনিট পর মুগ্ধ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অন্য শিক্ষার্থীর মতোই মুগ্ধর এই চলে যাওয়া ভাবিয়েছে এই অভিনেত্রীকে। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীদের এমন মৃত্যু ভীষণ অমানবিক। তিনি বলেন, ‘হতাশার অন্ধকারে ক্রমেই ডুবিয়ে দিচ্ছে আমাকে। বিদীর্ণ হচ্ছে বুকের ভেতর। মুগ্ধর মা কীভাবে সইবেন। আমার যমজ সন্তান আছে বলেই হয়তো আমার কলিজায় এমনভাবে খোঁচাচ্ছে।’ কথা শেষ করতে পারেন না এই অভিনেত্রী। বোঝা যায়, তিনি কাঁদছেন। কিছুটা থেমে ভাঙা গলায় তিনি বলতে থাকেন, ‘স্নিগ্ধ, মুগ্ধকে হারিয়ে তোমার কেমন লাগছে, সেটা আমি জানি।’
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীসহ নিরীহ সবার পরিবারের পাশে সবার থাকা দরকার বলে মনে করেন এই অভিনেত্রী। তিনি বলেন, ‘এমন মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। মুগ্ধ কিংবা মুগ্ধর মতো আরও যারা লুটিয়ে পড়ল জন্মভূমির কোলে, তোমাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে তোমাদের মায়েদের সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা নেই। চিরশান্তিতে ঘুমাও তোমরা দেশ মায়ের কোলে।’
আর কোনো প্রাণ যেন এভাবে না ঝরে, এটাই প্রত্যাশা করেন ছন্দা। তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট অনেক শিশু মারা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা মারা গেছেন। কোনো মৃত্যুই কি কাম্য? কে মেরেছে? কীভাবে মেরেছে দেখিনি, জানি না; কিন্তু যে-ই হোক, তারও সন্তান থাকতে পারে, থাকতে পারে ভাই। তবে কেন এই নারকীয়তা? কেন নিজের মস্তিষ্কে নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে গুলি করা? এটা হত্যা নয় শুধু; বরং যে গুলি করল, তারও আত্মহত্যা। পারবে কি সে কোনো দিন আয়নায় নিজের মুখ দেখতে? এই হত্যা কোনো দিন পিছু ছাড়বে না।’