‘নানা’কে নিয়ে ‘নাতি’র দুটি আক্ষেপ, শেষ দেখাও মেলেনি
তিনবার রিং হলো। এরপর অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ করলেন। জানালেন, মোটরসাইকেলে ছিলেন, তাই ফোন ধরতে পারেননি। পরে নিজে থেকেই এই প্রতিবেদককে জানালেন, কেন ফোন করেছি, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। আজ তাঁর ‘নানা’কে হারানোর দিন। জীবন তার নিজের মতো চলে গেলেও এই দিনে মন খারাপ থাকে। অনেক কিছু ভুলে থাকলেও ২৩ জানুয়ারি দিনটির কথা ভোলেন না। এই দিনে মারা যান অভিনেতা অমল বোস। ‘নানা’র জন্য এখনো নাতি নিপুর আফসোস রয়েছে। নিপুর পুরো নাম শওকত আলী তালুকদার। নানা-নাতির এই সম্পর্ক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ ঘিরে। পর্দার সেই সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে নানা-নাতির মতোই ছিল।
তাঁদের একসঙ্গে দেখলেই বলা হতো নানা-নাতি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই এই জুটি নিজেদের নাম ছাপিয়ে দর্শকদের কাছে নানা-নাতি হিসেবে এখনো সমাদৃত। অভিনয় থেকেই নানা অমল বোস ও নাতি নিপুর বোঝাপড়া শুরু। সম্পর্ক গড়িয়েছিল পরিবার পর্যন্ত। সময় পেলেই নিপু চলে যেতেন নানাবাড়ি। জীবনের অনেক কিছুই শিখেছেন অভিনেতা অমল বোসের কাছে। তাঁদের সেই জনপ্রিয় জুটি ভেঙে যায় ২০১২ সালে আজকের দিনে।
অমল বোসের প্রয়াণদিবসে প্রিয় মানুষকে স্মরণ করে নিপু বলেন, ‘দিনটির কথা কখনোই ভুলব না। এই দিনেই আমি নানাকে হারিয়ে একা হয়েছি। প্রতিটা মুহূর্তে নানাকে আমি মিস করি। যেখানেই যাই, দর্শক এখনো বলেন, ওই যে নানার নাতি যায়। দর্শকেরা মনে করতেন আমরা সত্যিকারের নানা–নাতি। তখন মনে হয়, নানা আমার সঙ্গে আছেন। একসঙ্গে অভিনয় করে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। আমি আর দাদা ছিলাম মানিকজোড়। দর্শক আমাদের নানা-নাতি হিসেবে চিনলেও আমি অমলদাকে সব সময় দাদা বলতাম।’
অভিনেতা অমল বোসের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েছিলেন নিপু। কারণ, আজকের এই দর্শক পরিচিতিতে সব সময় পাশে ছিলেন অমল বোস। সেই দিনগুলো এখনো ভোলেননি তিনি। নানার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিপু বলেন, ‘১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে হবে সম্ভবত, আমরা নানা-নাতির চরিত্রে অভিনয় করি। তখন আমি অভিনয়ের কিছুই জানতাম না। কিন্তু অমলদা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতেন। কীভাবে ডায়ালগ ডেলিভারি দিতে হয়, ক্যামেরা মুভমেন্ট করতে হয়। এমনকি জীবন কীভাবে চালিয়ে যেতে হবে, সেটাও শেখাতেন। তখন থেকেই আমাদের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হয়।’
তাঁরা একসঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে স্টেজ অনুষ্ঠান করতে যেতেন তাঁরা। এই সময়টা ছিল নিপুর জন্য শিক্ষণীয়। তিনি অমল বোসের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতেন। ‘নানা আমাকে হাতে ধরে ধরে সব শিখিয়েছেন। তখন বুঝতাম, মানুষটা ভালো অভিনেতাই নন, ভালো একজন মানুষও। আমি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে চাইতাম। ছুটে চলতাম দেশের আনাচকানাচে। বোঝাতেন, দর্শকেরাই শিল্পীর প্রাণ। তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে বলতেন। নানা কাছে নিয়ে বলতেন, “এইভাবে মাইক্রোফোন ধরবি। এইভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলবি।” একসঙ্গে অনেক সময় কেটেছে। নানা আমাকে শিখিয়েছেন, জীবনে খুব বেশি কাজের দরকার নেই। ভালো কাজ কম হলেও দর্শক সেই কাজ দিয়েই মনে রাখবে। সে কারণে এখনো কম কাজ করি।’ বলেন নিপু।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে যেতেন, সেখানে দর্শকেরা আপনাদের কী বলতেন? এমন প্রশ্নে নিপু জানান, ‘ইত্যাদি’তে অভিনয় করে আলোচিত হওয়ার পরই তাঁরা বেশি ডাক পেতেন। দেশের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠান করতে হতো। ভক্তরা কাছে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। নানা-নাতিকে ঘিরে ধরতেন। কেউ ছুঁয়ে দেখতে চাইতেন। কেউ বলতেন অভিনয় করে দেখাতে। কখনো তাঁরা ভক্তদের সঙ্গেও জুড়ে দিতেন আড্ডা।
একসঙ্গে অভিনয় ও অনুশীলন করতে গিয়ে প্রায়ই তাঁদের দেখা হতো। নিপু বেশির ভাগ সময় ছুটে যেতেন অমল বোসের বাড়িতে। সম্পর্কটা একসময় পরিবার–ঘনিষ্ঠ হয়। তাঁরা দেখা হলে মন খুলে কথা বলতেন। দুটি আক্ষেপের কথা শোনালেন নিপু।
অমল বোস মারা যাওয়ার আগে মাছ খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ মারা যাওয়ার কারণে নানাকে মাছ খাওয়াতে পারেননি। এটাই তাঁর বড় আক্ষেপ। জানালেন, যখন যেতেন, নানার পছন্দের ফল ও অন্যান্য খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মাছ খাওয়ানোর আক্ষেপ আর ঘোচাতে পারবেন না। নিপু বলেন, ‘আমার এই আক্ষেপ সারা জীবন মনে থাকবে। এখনো আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় মাছ খাওয়ানোর ঘটনাটা। নানা হঠাৎ মারা যান। আর সেই সময় আমি বিদেশে ছিলাম। নানাকে আমি শেষ দেখা দেখতে পারিনি, এই কষ্ট আমি আজীবন বয়ে বেড়াব। দুটি ঘটনা আমাকে খুবই কষ্ট দেয়।’
জনপ্রিয় অভিনেতা অমল বোসের জন্ম ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে। ষাটের দশকে তিনি মঞ্চনাটকের মাধ্যমে অভিনয়ে পা রাখেন। অবসর, শৈবাল, রংধনু নাটকের দলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই সময় তাঁর অভিনয় শুরু হয় পাড়ার যাত্রাদলের নাটক দিয়ে। এভাবেই তিনি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মঞ্চে অভিনয় করে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে ‘রাজা সন্ন্যাসী’ সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় নাম লেখান অমল বোস। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘অবিচার’, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘আমি সেই মেয়ে’, ‘তোমাকে চাই’, ‘মন মানে না’, ‘শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ’সহ অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁকে বাবা, পুলিশ, খল চরিত্রসহ সব চরিত্রেই তাঁর অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো।