১৫ লাখ নয়, ১৬ টাকার ছাগল আমাকে কাঁদিয়েছিল: ফারুক আহমেদ

ফারুক আহমেদ। ছবি: ফেসবুক

‘কিছু মানুষের মূল্যবোধ, মানবিকতা মনে হচ্ছে দিন দিন কমছে। এটা আমার মনে হয়। যে কারণে অনেকেই অবৈধ উপায়ে বাছবিচার না করে অর্থ উপার্জন করছেন। কেউ কেউ এটাকে নিয়মে পরিণত করেছেন। বেড়েই চলেছে শো-অফের ঘটনা। শিল্পী হিসেবে ঘটনাগুলো আমাকে ব্যথিত করে।’ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাগল–কাণ্ড নিয়ে কথাগুলো বলেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। ছাগল–কাণ্ড তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছে শৈশবের একটি ঘটনা। ৯ বছর বয়সে ছাগল নিয়ে তাঁর জীবনে আছে একটি দুঃখের ঘটনা।

শৈশবে অভিনেতা ফারুক আহমেদ পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। স্কুল ছুটি হলে প্রায়ই চলে যেতেন গ্রামের বাড়িতে। একবার গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে গিয়ে ১৫ দিন বাড়িতে ছিলেন। তখন বাড়িতে যাওয়া মানেই ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। চার ভাইবোনের গ্রামের মাঠে–ঘাটে সারা দিন দাপিয়ে বেড়ানোই ছিল নিয়ম। ঢাকায় ফেরার কথা মনে হলেই বুকটা কষ্টে ভরে যেত। তারপরও ঢাকায় ফিরতে হতো।

ফারুক আহমেদ। ছবি: ফেসবুক

একবার মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছেন। এমন সময় এই অভিনেতার হঠাৎ চোখ যায় একটি কালো ছাগলের দিকে। ছাগলের ছোট্ট বাচ্চা। ছাগলটি খুবই পছন্দ হয় ফারুকের। কেউ একজন ছাগলটিকে বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন। এ কথা শুনে ফারুক বায়না ধরলেন যে ছাগলটি কিনবেন। তাঁর মা-বাবা কেউই রাজি নন। কারণ, এটিকে তাঁদের সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া, লালন–পালন করা কঠিন। তবু নাছোড়বান্দা ফারুক আহমেদ; ছাগলটি তাঁর চাই-ই।
সেই স্মৃতি মনে করে অভিনেতা বলেন, ‘তখন আমি আমার ফুফুকে অনুরোধ করি ছাগলটি দেখে রাখতে। তিনি রাজি হন। ছাগলটির দাম চেয়েছিল ২০ টাকা। পরে দর-কষাকষি করে ১৬ টাকায় ঠিক হয়। কিন্তু টাকা পাব কোথায়? মাকে বললাম। মা বললেন, “এত টাকা আমি পাব কোথায়? তোর বাবাকে বল।” আমি আব্বার কাছে গিয়ে ১৬ টাকা চাইলাম। আব্বা বললেন, “বাবা আমি স্কুলশিক্ষক। ১৬ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার সামর্থ্য আমার নাই।” আব্বাকে বললাম, আব্বা আমার কাছে ৫ টাকা আছে, আপনি ১১ টাকা আমাকে দেন। আব্বা সন্তানের মনরক্ষার জন্য আমাকে পকেট থেকে ১১ টাকা বের করে দিলেন। কেনা হলো ছাগল।’

ফারুক আহমেদ। ছবি: ফেসবুক

কথাগুলো বলেই কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল এই অভিনেতার। কিছু সময় চুপ থেকে ফারুক আহমেদ বলতে শুরু করলেন, ‘সেই অল্প বয়সে আমি বুঝিনি যে ১১ টাকা দিতে আব্বার কত কষ্ট হয়েছে। কারণ, বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। একদম বাড়তি কোনো কিছু করার উপায় ছিল না আমাদের। কষ্টে আমাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে চলতে হতো। কিন্তু বাবা সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করার চেষ্টা করতেন। সেখানে ১১ টাকা বাড়তি খরচ মানে বিলাসিতা। সেবার হয়তো আমি সবাইকে অনেকটা বিপদেই ফেলেছিলাম।’
অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হলেও শিক্ষক বাবার কাছ থেকেই ফারুক আহমেদ শিখেছিলেন মানবিকতা, মূল্যবোধ, মানুষকে সম্মান করা, সততা, মিতব্যয়িতা। এই অভিনেতা বলেন, ‘একটি সন্তান শৈশব থেকে সবচেয়ে বেশি শিখে থাকে তাঁর পরিবার থেকে। মা-বাবাসহ পরিবারের ঘনিষ্ঠরা সবাই যা শেখাবেন, শিশু সেটাই শিখবে। এই জন্য সন্তানদের বেশি সময় দিতে হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না, এটা সন্তানদের বোঝাতে হয়। তা না হলে সন্তান বখে যায়। সন্তানের ভালোর জন্য পরিবারের ভালো শিক্ষাগুলো দেওয়া জরুরি।’

এই অভিনেতা মনে করেন, যাঁরা বেআইনিভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন, তাঁরা সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতি করছেন। একটি জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ সম্পদের পাহাড় গড়লে সেই প্রভাবে গরিব থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় চাপ তৈরি হয়। অন্যায়ভাবে যাঁরা অর্থ কামাচ্ছেন, তাঁদের দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন। এমনকি এই সব লোভী ব্যক্তির পরিবারও অনেক সময় একই পথে হাঁটছে।
ফারুক বলেন, ‘প্রতিটি পরিবারে সন্তানদের সততা শেখানো জরুরি, তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কর্মঠ হিসেবে তৈরি করতে হবে। আপনার সন্তানেরা পড়াশোনার প্রতি কতটা মনোযোগী, খবর রাখুন। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। আমাদের অন্যের কষ্ট বুঝতে শিখতে হবে। তাহলে সন্তান যেমন বাবার দুঃখে কাঁদবে, বাবাও সন্তানের জন্য কাঁদবেন।’

ফারুক আহমেদ। ছবি: ফেসবুক

ফারুক আহমেদ এবার ফিরে গেলেন সেই শৈশবে। সেই ছাগল কেনার পরের ঘটনায়। ছাগলটি কিনে ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে গ্রামে। সেই কালো ছাগলের কথা প্রায়ই ভাবেন তিনি। কল্পনা করতেন যে ছাগলটা দিন দিন বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে এসেছে মনে। এই নিয়ে কত ছেলেমানুষি করেছেন তিনি। পরে তাঁদের আবার সুযোগ হয় গ্রামে যাওয়ার।
‘গ্রামে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফুফু জানান, আমার ছাগলটা নাকি তিন মাস পরই মারা গেছে। শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার কান্না চলে আসে। আমি কাঁদছি। আব্বা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, “কেঁদো না থাক বাবা, তোমাকে এবার আরও সুন্দর একটা ছাগল কিনে দিব।” আমি আব্বার চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তাঁর চোখ ভেজা। বাবাও কাঁদছেন। দুচোখ থেকে গড়িয়ে পানি ঝরছে।’ বলেন ফারুক আহমেদ।
বাবার সেই কান্নার অর্থ তখনো বোঝার বয়স হয়েছিল না ফারুক আহমেদের। শুধুই এটাই বুঝেছিলেন যে আর কখনোই হয়তো ছাগল কেনার সামর্থ্য হবে না তাঁর। ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আব্বা আমাকে খুশি করার জন্য মাত্র ১৬ টাকা দিয়ে আরেকটি ছাগলের বাচ্চা কিনে দিতে পারেননি। আমার তাতে কোনো দুঃখ নেই। বরং আমার গর্বে বুক ভরে যায়, আমার আব্বা সৎ জীবনযাপন করেছেন বলে। অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করে সন্তানকে ছাগল কেনার ১৬ টাকা দেননি। আমাদের বাস্তবতা শিখিয়েছেন।’