প্রথম আলো :
দীর্ঘ সময় প্রিয় লেখকের সাহচর্যে ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে বড় পাওয়া কী? তাঁকে কতটা অনুভব করেন?
মনির হোসেন জীবন: স্যারকে শুধু আজ নয়, প্রতিনিয়তই অনুভব করি। একজন নির্মাতা হিসেবে জীবনের সবকিছুই তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। কোনো ছোট বিষয়কে কীভাবে বড় করে তোলা যায়, আবার বড় বিষয়কে কীভাবে ছোট করা যায়, নাটকের সংলাপ লেখা, সবই তাঁর কাছে থেকে পেয়েছি। তিনি বটবৃক্ষ। আমরা যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছি, তাঁরা সেই বটগাছের পাতা। কিন্তু বর্তমানে খারাপ লাগে, স্যার টেলিভিশন স্ক্রিনে সেভাবে নেই। কেন জানি না। আমার ইচ্ছা আছে স্যারকে ঘিরে কাজ করার।
প্রথম আলো :
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
মনির হোসেন জীবন: ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে স্যারের সঙ্গে প্রথম দেখা। তখন স্যার ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার শুটিং করছেন। আমি তখন কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতাম। টাকার বিনিময়ে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে কাজ শুরু করি। তখন কাজের বাইরে তেমন একটা কথা হতো না। স্যারের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কাজ করার পর একদিন ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন বুলু ভাই বললেন, ‘হুমায়ূন স্যার তো একটি হাউস দাঁড় করাবেন। একজন জানাশোনা, শিক্ষিত লোক খুঁজছিলেন। তোমার কথা বলব।’ পরে আনোয়ার ভাই জানান, স্যার আমাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে বাসায় গিয়ে দেখা করি।
প্রথম হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেই কাজ শুরু করলেন?
মনির হোসেন জীবন: না, আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। স্যার আমাকে চিনলেন। পরে বললেন, ‘তুমি কাজ শুরু করো।’ আমি তখন হুমায়ূন স্যারকে বললাম, ‘স্যার আমার জয়েন করতে তিন মাস সময় লাগবে।’ স্যার একটু মন খারাপ করলেন। কারণ, স্যারের মুখের ওপর এভাবে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। স্যারকে বললাম, ‘আমি কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করি। তাঁদের সিনেমার কাজগুলো শেষ করে না এলে তাঁরা বিপদে পড়বেন। আমি কাউকে বিপদে ফেলতে পারব না। আমার ধারণা, স্যার আমার এই কথা খুবই পছন্দ করেছিলেন। আমি সব সময়ই সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। পরে সময়মতো নুহাশ চলচ্চিত্রে যোগ দিই।’
প্রথম আলো :
শুনেছি স্যার অনেক সময়ই জানিয়েছেন, আপনি নুহাশপল্লী গড়ে তোলার সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। জঙ্গলের মধ্যে স্যার কেন জায়গা পছন্দ করেছিলেন?
মনির হোসেন জীবন: ‘সবুজ সাথী’ নাটকের শুটিং হয়েছিল হোতাপাড়া। এমন একটা জায়গায় শুটিং করেছিলাম, যেখানে জঙ্গল আর জঙ্গল। সেখানে মানুষ ডাকলে পাওয়া যেত না, কিন্তু কুকুর পাওয়া যেত। আমরা জঙ্গলের পাশেই একটি মুরগির ফার্ম পরিষ্কার করে টিম নিয়ে থাকা শুরু করি। অনেক দিন জঙ্গলে থাকার পর স্যার একদিন বললেন, ‘জঙ্গলে থাকতে তো ভালোই লাগে। প্রকৃতিকে সরাসরি উপভোগ করা যায়। পাখির ডাক, সাপ, ব্যাঙ সব সময় দেখছি, ভালোই তো। খুঁজে দেখো তো কোথায় জায়গা কেনা যায়?’ তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই জঙ্গলের মধ্যেই জমি কিনে বাড়ি বানাবেন।
তখন নুহাশপল্লীর জন্য জায়গা খুঁজে বের করেন ডা. এজাজ। জায়গাটা অনেক ভেতরে ছিল। গরুর গাড়ি নিয়ে যেতে হতো। তারপরও স্যার পছন্দ করেছিলেন কেন?
মনির হোসেন জীবন: এজাজ সাহেবকে বললাম, ‘স্যারের জায়গাটা খুবই পছন্দ হয়েছে।’ তিনি স্যারের সঙ্গে কথা বলে জায়গা খুঁজতে গেলেন। একদিন এসে জানালেন জায়গা পেয়েছেন। স্যার বললেন, ‘তুমি দেখে এসো।’ আমি গিয়ে দেখে আসি। এসে জানালাম, ‘জায়গাটা জঙ্গল আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। নৌকা নিয়ে যেতে হয়। গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। রাস্তাঘাট নেই, অনেক ঝুটঝামেলা আছে।’ এই ঝুটঝামেলা আছে শুনেই হুমায়ূন স্যার আরও বেশি আগ্রহী হয় উঠলেন। কেন ঝামেলা? পরে ২২ বিঘার মতো জায়গা পাওয়া গেল। স্যার দেখে কিনে ফেললেন। আশপাশে জঙ্গল হলেও জায়গাটা খোলামেলা ছিল। তখন স্যার আমার ওপর কাজের দায়িত্ব দিলেন।
স্যার আমাকে বিশ্বাস করতেন। আমি কখনোই নীতিভ্রষ্ট হইনি। এটা যাঁদের সঙ্গে চলেছি, অনেকেই জানেন। কারণ, আমি যদি তখন নীতিভ্রষ্ট হতাম বা দুই নম্বরি করতাম তাহলে নুহাশপল্লী করা কঠিন হয়ে যেত। অনেকেই বলে স্যারের ডান হাত, বাঁ হাত ছিলাম। তো ডান হাত, বাঁ হাত এদিক-সেদিক করলে প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতি।
হুমায়ূন আহমেদের রচনায় ‘আজ রবিবার’ নাটকটি পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছিল কীভাবে?
মনির হোসেন জীবন: ‘নক্ষত্রের দিনরাত্রি’সহ বেশ কিছু একক কাজ ভালো করে দিলাম। পরে স্যার ১৯৯৬ সালে একদিন নাটকটির গল্প শোনালেন। পরে বললেন, ‘পারবা না পরিচালনা করতে?’ আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, পারব না কেন, কিন্তু স্যার আমি আরেকটু পরে ডিরেক্টর হতে চাই।’ স্যার বললেন, ‘না না, সুযোগ কাজে লাগাতে হয়।’ পরে বলি, ‘স্যার আপনি যা ভালো মনে করেন।’
প্রথম আলো :
হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ নিয়ে কি কখনোই কিছু বলতেন?
মনির হোসেন জীবন: তিনি আমাকে পরিচালক হিসেবে শতভাগ স্বাধীনতা দিয়েছেন। কখনোই কিছু বলতেন না। তাঁর চিত্রনাট্য কখনোই বলার মতো কিছু থাকত না।
প্রথম আলো :
প্রথম আলো: দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করার পর ২০০০ সালে হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান কেন?
মনির হোসেন জীবন: আমি ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ নামে প্রতিষ্ঠান করি। কেন, সেটা বলতে চাই না। হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ছিল, সম্পর্কের অবনতি হয়নি। স্যার মারা যাওয়ার আগেও নুহাশপল্লীতে বৈশাখ উদ্যাপন করেছিলেন। তখন দুই দিন আগেই ফোন দিয়ে বলেছিলেন যেতেই হবে। আমার দুই মেয়েকে নিয়ে স্যার নুহাশপল্লী ঘুরে দেখালেন। স্যারের সঙ্গে সব সময় আগের মতোই সম্পর্ক ছিল। যদিও নুহাশ চলচ্চিত্র থেকে বের হয়ে আসার পরে অনেককে চিনেছি, বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। নতুন করে কাজ করেছি।