যৌন হয়রানি, বাজে পরিবেশ আরও যেসব কারণে ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’ ছাড়ছেন শিল্পীরা
ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’। এই ধারাবাহিকটি এত জনপ্রিয় হয়েছে যে নিজেদের ছবির প্রচারের জন্য শাহরুখ, সালমান থেকে শুরু করে বলিউডের অনেক তারকাই উপস্থিত হয়েছেন এই ধারাবাহিকের নানা পর্বে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন অভিযোগে ধারাবাহিকটি ছাড়ছেন কলাকুশলীরা। তাঁদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে শুটিং সেটের অসুস্থ পরিবেশ, যৌন হয়রানি, পারিশ্রমিক না দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ।
একটি হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করা কয়েকটি পরিবারের মজার গল্প নিয়ে নির্মিত ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’। এত জনপ্রিয় একটি ধারাবাহিকের বিরুদ্ধে কেন এত অভিযোগ? এই ধারাবাহিকের ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা কথা বলেছে এই ধারাবাহিকের কয়েকজন কলাকুশলীর সঙ্গে।
সবার অভিযোগের তির এই ধারাবাহিকের প্রযোজক অসিত কুমার মোদির দিকে। তাঁরা বলছেন, অসিত কুমার মোদির কঠোর নীতিমালা, শিল্পীদের মূল্যায়ন না করা, শুটিং সেটে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে সেটের সুস্থ পরিবেশের বিঘ্ন ঘটছে।
এই ধারাবাহিকে রিতা রিপোর্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়া আহুজা। তিনি বলেন, ‘করোনার পর যখন আবার ধারাবাহিকের শুটিং শুরু হয়, তখন আমার কোলে ছোট বাচ্চা। প্রযোজক কিংবা নির্মাতারা কেউ তখন আমাকে ফোন করেননি। আমি চেয়েছিলাম, এই ধারাবাহিক দিয়ে অভিনয়ে ফিরতে। কিন্তু সেই সময় আমি ফোন করলেও প্রযোজক ও অন্য নির্মাতারা ফোন ধরেননি।’ এরপর নির্মাতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। এত বছর অভিনয় করেও তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি বলে অভিযোগ করেন প্রিয়া।
প্রিয়া আরও বলেন, ‘প্রযোজক আমাদের এসে বলতেন, আমরা তোমাদের জন্য এটা করেছি, ওইটা করেছি, তোমাদের তারকা বানিয়েছি। কিন্তু আমরা যদি অভিনয় না করতাম, তাদের কাজ না করতাম, তাহলে এটা শো হতো না। আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা কোনোটাই নেই।’
প্রিয়া জানান, শুটিংয়ের সময় কোনো ধরনের হয়রানি বা কারও দুর্ব্যবহারের শিকার হননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, এই ধারাবাহিকে যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁরা অন্য কোথাও কাজের ছুটি বা অনুমতি পেতেন না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ছবি, ভিডিও শেয়ার করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকত। তাঁদের সঙ্গে চুক্তি ছিল, এই ধারাবাহিকের শিল্পীরা অন্য কোথাও অভিনয় করতে পারবেন না। তবে এই চুক্তির বাইরে একমাত্র শিল্পী ছিলেন প্রিয়া। তবু তিনি এ ধরনের চুক্তিকে শিল্পীদের হয়রানি করা বলে মনে করেন।
তারক মেহতা চরিত্রে অভিনয় করা শৈলেশ লোধা ও আরেক অভিনয়শিল্পী রাজ আনাদকাটও কিছুদিন আগে এই ধারাবাহিক ছেড়েছেন। শৈলেশ তাঁর কবিতা অনুষ্ঠানের জন্য সময় চেয়েছিলেন, অন্যদিকে রাজ মিউজিক ভিডিও ও রিয়েলিটি শোয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু অসিত কুমারের কঠোর নীতির কারণে তাঁরা সেই কাজগুলো করতে পারছিলেন না। এই কারণেই তাঁরা এই ধারাবাহিক ছেড়েছেন।
শিল্পীদের সঙ্গে এ ধরনের কঠোর চুক্তি প্রসঙ্গে প্রযোজক অসিত কুমারের সঙ্গে কথা হয়েছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের। অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘দর্শকের সঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের সংযুক্ত রাখার একটা কৌশল এই চুক্তি। এই বিশেষ চরিত্রগুলোর জন্য তাঁরা দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছেন। বিশেষ এই চরিত্রের কারণে দর্শকের কাছে ধারাবাহিকের এত জনপ্রিয়তা। তাঁরা যদি এর বাইরে গিয়ে অন্য চরিত্রেও অভিনয় করেন, তাহলে ধারাবাহিকটি জনপ্রিয়তা হারাবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ধারাবাহিকের সাবেক এক সদস্য জানান, অভিনেত্রী দিশা ভাকানি এই ধারাবাহিক ছেড়ে দেওয়ার পর ধারাবাহিকের দর্শকের সংখ্যা কমে যায়। ধারাবাহিকের মানও নিম্নগামী হতে শুরু করে। এ সময় অনেক দর্শক, নির্মাতাদের কিছুদিন বিরতি নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রটি আরও জানায়, এটি একটি পারিবারিক কমেডি শো, দর্শকেরা ভাবেন এই ধারাবাহিকে যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা একটা পরিবারের মতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চায় না।
প্রিয়ার স্বামী এই ধারাবাহিকের সাবেক পরিচালক মালব রাজদা। চলতি বছরের শুরুতে ধারাবাহিক নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়ায় তিনিও বের হয়ে যান। মালব বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল পরিচালক হওয়ার; কিন্তু শুটিং সেটের এই নেতিবাচক বিষয়গুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করছিল। একসময় শুটিং সেটে যেতে ভয় লাগা শুরু করল। আমার মনে হলো, যদি আমি উন্নতি করতে চাই, তাহলে এই শো ছেড়ে দিতে হবে।’
মালব আরও বলেন, ‘প্রযোজকদের সঙ্গে হয়তো আমার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু অন্যরা যা বলছে, তা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। অভিনেতা ও প্রযোজকদের মধ্যে যে চুক্তি সেসব বিষয়ে আমি কখনো হস্তক্ষেপ করিনি। এমনকি আমার স্ত্রীর বিষয়েও না।’
সর্বশেষ প্রযোজক অসিতের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এই ধারাবাহিকের অভিনেত্রী জেনিফার মিস্ত্রি বনসিওয়াল। তার আগে শুটিং সেট থেকে বের হওয়ার সময় শোয়ের হেড অপারেশনস সোহিল রামানি এবং তাঁর সহকারী যতীন বাজাজের কাছে হয়রানির স্বীকার হন অভিনেত্রী। এরপরই শো ছেড়ে দিয়েছিলেন জেনিফার। এ সময় অভিনেত্রীকে দোষারোপ করে তাঁরা বলেন, ‘জেনিফার সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। শুটিংয়ের সময় তাঁর খারাপ আচরণ এবং শৃঙ্খলাহীনতার কারণে আমাদের তাঁর চুক্তি বাতিল করতে হয়েছিল।’
অভিনেত্রী হঠাৎ শো ছাড়ায় তাঁদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রযোজক নোটিশ পাঠান অভিনেত্রীর কাছে। এরপরই মুখ খুললেন জেনিফার। প্রযোজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, তাঁকে বিভিন্ন সময় যৌন ইঙ্গিত দিতেন প্রযোজক অসিত। কিন্তু কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে এত দিন তিনি চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন আর চুপ থাকবেন না বলেও জানান তিনি। অভিযোগের পর প্রযোজক এই বিষয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অভিনেত্রীর চুক্তি বাতিল করায় তিনি আমাকে এবং শো উভয়ের মানহানি করার চেষ্টা করছেন।’ সঙ্গে অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেন প্রযোজক।
প্রযোজক অস্বীকার করলেও থেমে থাকবেন না জেনিফার। তিনি জানান, তাঁর স্বামী তাঁর পাশে আছেন। তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘এমন প্রযোজকদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। তাঁদের সম্পর্কে সবাই জানুক। আমি সবাইকে তাঁদের বিষয়ে জানাতে চাই।’