যা ভেবেছিলেন মাহফুজ, হয়েছে যা
সাংবাদিকতা ছেড়ে অভিনয়ে আসেন মাহফুজ আহমেদ। পার হয়ে গেছে তিন দশকের বেশি সময়। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন। মাঝখানে আট বছর সব ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলেন। গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘প্রহেলিকা’ চলচ্চিত্র দিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন। যুক্ত হয়েছেন নতুন কাজেও। ফিরে আসা মাহফুজকে নিয়ে এই আয়োজন।
মাহফুজ আহমেদকে সর্বশেষ ‘জিরো ডিগ্রি’ চলচ্চিত্রে দেখা যায়। এরপর আর কোথাও ছিলেন না তিনি। ক্যামেরার সামনেই দাঁড়াননি আট বছর। তাই তো চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রহেলিকা’ ছবি নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় ছিলেন। কী হবে, কীভাবে দর্শক তাঁকে গ্রহণ করবেন—ছিল এসব ভাবনা। তবে ফেরাটা যেমন ভেবেছিলেন, তার চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন। ‘প্রহেলিকা’ চলচ্চিত্রে মাহফুজ আহমেদ মনা চরিত্রে অভিনয় করেন। মনা মানুষের মনে জায়গা করে নিতে বেশি সময় নেয়নি। বিরতির পর ফেরা মাহফুজকে ছবির ‘মেঘের নৌকা’ গানে প্রথমবার দেখা মেলে। টেলিভিশন নাটকের রোমান্টিক বয় এই গানে যেন সেই মুগ্ধতাই ছড়ালেন। ছবি মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহের দর্শকেরা যেন বিরতির পর ফেরা মাহফুজকে সাদরে বরণ করে নিলেন।
এই অভিনয়শিল্পীর কথায়ও তা স্পষ্ট, ‘সত্যিই, আমি খুব শঙ্কিত ছিলাম। ভেবেছিলাম, দর্শক আদৌ মনে রেখেছেন কি না। ছবি মুক্তির পর দুই দিন হল ভিজিট করেছি। মনটা ভিজে গেছে। দর্শক এত মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না। মা-বাবা, চাচা-চাচি, খালা-খালুর বয়সীরা তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, “আমরা নাতি-নাতনিদের নিয়ে এসেছি, আমাদের হিরোকে দেখাতে।” এর চেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট আর কী হতে পারে। দর্শকের এ ধরনের মন্তব্য আমার নিজের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে। আদৌ গ্রহণ করবেন কি না, সেই শঙ্কা কেটে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসব। তাই তো নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছি।’
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা
‘প্রহেলিকা’ ছবিটি মুক্তির আগে মাহফুজ আহমেদকে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা শুভকামনা জানিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন ভিডিও বার্তা, কেউ ফেসবুকে লিখিত পোস্টও দিয়েছেন।
এই তালিকায় শাবনূর, শাকিব খানরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন জয়া আহসান, তারিন, পূর্ণিমা, চঞ্চল চৌধুরী, অপি করিম প্রমুখ। সহশিল্পীদের কাছ থেকে পাওয়া এসব শুভকামনা তাঁকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে। সহশিল্পীদের আন্তরিক শুভকামনার কথা জীবনেও কখনো ভুলবেন না বলে জানালেন মাহফুজ।
তিনি বললেন, ‘কারণ, আমি নিজেকে একজন মধ্যম মানের অভিনেতা মনে করি। আমি যে ব্রিলিয়ান্ট অ্যাক্টর নই, এটা খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু আমি সব সময় ব্রিলিয়ান্ট সব কো-অ্যাক্টর পেয়েছি। শমী, মিমি, বিপাশা, তারিন, অপি করিম, জয়া আহসান—এমনকি সুবর্ণা আপার সঙ্গে একাধিক কাজ করেছি। তাদের সঙ্গে কাজ করায় যেটা হয়েছে, সহকর্মীরা এত বেশি শক্তিশালী অভিনয়শিল্পী, যা আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমি অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে শিখেছি। জেনেছি। বুঝতে পেরেছি।’ একইভাবে সব পুরুষ সহশিল্পীর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানালেন মাহফুজ। তিনি জানালেন, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, আজিজুল হাকিম, শহীদুজ্জামান সেলিমদের মতো সব জাঁদরেল সহশিল্পীর মধ্যে থাকাতে তাঁদের ঘষামাজায় তৈরি হতে পেরেছেন মাহফুজ।
বললেন, ‘আমি সব সময় সহশিল্পীদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমি ভালো ভালো পরিচালকের সঙ্গেও কাজের সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ যেমন আছেন, তেমনি সরয়ার ফারুকী, গিয়াসউদ্দিন সেলিমসহ সবার সাহচর্য পেয়েছি। তাঁরা ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিয়েছেন। কাজে ভালো করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। তাই সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বললেও ভুল হবে, আমি তাঁদের কাছে প্রতিনিয়ত নত হই। আমি বুঝতাম না, তারপরও আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমি পারতাম না, আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এই প্রশ্রয়টার ক্ষেত্রে একজন আফজাল হোসেনের কথা বিশেষভাবে বলব। তিনি আমার অন্যতম একজন অনুপ্রেরণা।’
বেড়েছে দায়িত্ববোধ
মাহফুজ আহমেদের সমসাময়িক অনেক পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পী প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ‘প্রহেলিকা’ ছবিটি দেখেছেন। তাঁরা এমনও বলেছেন, মাহফুজের ফিরে আসাটা রাজকীয় হয়েছে। এমন একটা গল্পের ছবি দিয়েই তাঁর ফেরাটা দরকার ছিল। আফজাল হোসেন তাঁর পরিবার ও দলবল নিয়ে ছবিটি দেখেছেন। মাহফুজের জন্য একটা পার্টি দেওয়ার কথাও ভেবেছেন আফজাল, জানালেন মাহফুজ। তবে সবার এমন ভালোবাসা মাথায় তুলে রাখতে চান এই অভিনেতা। তাঁদের সম্মানে আর লম্বা বিরতিতে যেতে চান না মাহফুজ।
দর্শকেরা আমার কাছে অভিনয়নির্ভর, গল্পনির্ভর কাজ দেখতে চান। চরিত্রনির্ভর ভিন্ন মেজাজের কিছু আশা করেন। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে পরবর্তী যে কাজটা তৈরি হচ্ছে, এসব বিষয় মাথায় রেখেই হচ্ছে
তিনি বলেন, ‘অনেকে অনেকভাবে আমার ফেরাটাকে মূল্যায়ন করছেন। তবে আমি বলব, যে ভালোবাসায় আমি সিক্ত হয়েছি, এত বছর পর কাজ করে, আমি দর্শকদের এই ভালোবাসা ও সম্মান মাথায় তুলে রাখব। সম্মান দেখানোর জন্য প্রতিবছর একটা চলচ্চিত্র ও ওটিটিতে একটা কাজ করব। এটা একদম মনেপ্রাণে আমি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছি। অচিরেই আমার পরের সিনেমার খবর সবাই জানতে পারবেন।’
পরের ছবিটি কোন ধরনের, জানতে চাইলে মাহফুজ বললেন, ‘দর্শকেরা আমার কাছে অভিনয়নির্ভর, গল্পনির্ভর কাজ দেখতে চান। চরিত্রনির্ভর ভিন্ন মেজাজের কিছু আশা করেন। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে পরবর্তী যে কাজটা তৈরি হচ্ছে, এসব বিষয় মাথায় রেখেই হচ্ছে।’
ফিরলেন ওটিটিতেও
বিরতির পর ফিরে চলচ্চিত্রে প্রশংসিত হচ্ছেন। এরই মধ্যে অভিনয়ের নতুন মাধ্যম ওটিটিতে ফেরার খবরটাও চাউর হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ মাহফুজ। কোনো কিছু নিজের মুখে না বললেও মাহফুজ আহমেদ এটুকু বললেন, ‘ওটিটি ফেরার জন্য আমি যে ধরনের একটি কাজের খোঁজ করছিলাম, এটা তেমনই। যে মাহফুজকে কেউ কখনো দেখেননি। মনা চরিত্রটা দেখার পর তো আগের সবটা মানুষ ভুলে যাচ্ছেন। তেমনি এই ওটিটির মাহফুজকে আগে কেউ দেখেননি। আমি মনেপ্রাণে এমন একটা কাজ দিয়েই ফিরতে চেয়েছি। কী হবে না হবে, তা তো দর্শক বিচার করবেন, কিন্তু আমি যেমনটা চেয়েছিলাম, ঠিক তেমন চ্যালেঞ্জ নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হচ্ছি। এটাই আনন্দের। আমি এই পরিচালকের কাছে সমর্পিত। একজন অভিনয়শিল্পী অসাধারণ একজন পরিচালকের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলে যেমন সমর্পণ করেন, আমি তেমনই করতে বাধ্য হয়েছি।’
‘অদৃশ্য’ নামের একটি ওয়েব সিরিজের শুটিং ঈদের আগেই শুরু করেছেন তিনি। শাফায়েত মনসুর পরিচালিত এই সিরিজে মাহফুজের বিপরীতে দেখা যাবে অপি করিমকে।
মাহফুজ আহমেদ কিছু না বললেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ‘অদৃশ্য’ নামের একটি ওয়েব সিরিজের শুটিং ঈদের আগেই শুরু করেছেন তিনি। শাফায়েত মনসুর পরিচালিত এই সিরিজে মাহফুজের বিপরীতে দেখা যাবে অপি করিমকে।
চলচ্চিত্র পরিচালনায় মাহফুজ
অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক বানিয়েছেন মাহফুজ। এবার জানা গেল, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও দেখা যাবে তাঁকে। এ বিষয়ে মাহফুজ আহমেদ বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চলচ্চিত্র বানাব। স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়ে গেছে। প্রথম ড্রাফট শেষ। এখন এটার অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন চলছে। হয়তো এই বছর প্রস্তুতিতে যাবে।’ টেলিভিশন নাটক পরিচালনার পাশাপাশি নিজে অভিনয় করতেন মাহফুজ। তবে চলচ্চিত্রে শুধুই পরিচালক হিসেবে থাকবেন। কে কোন চরিত্রে থাকবেন, তা-ও মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
আমি পরীক্ষিত ফিল্মের পরিচালক নই, তাই এটা আমার জন্য একটা বড় পরীক্ষা। সেই বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ভালোভাবে পাসও করতে চাই। আগামী বছরের শুরুতে ছবি বানাব
মাহফুজ বলেন, ‘আপাতত কাস্টিং নিয়ে কিছুই বলব না। ভাবনাগুলো পরিণত হচ্ছে। তবে আমি নিজে একদমই অভিনয় করতে চাই না। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শুটিংয়ে যাওয়ার আগের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমরা সেটাই করছি। ভালো ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ মেধা, পরিশ্রম, সময় দরকার হয়, সেভাবে একটু একটু করে এগোচ্ছি। আমি পরীক্ষিত ফিল্মের পরিচালক নই, তাই এটা আমার জন্য একটা বড় পরীক্ষা। সেই বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ভালোভাবে পাসও করতে চাই। আগামী বছরের শুরুতে ছবি বানাব।’