‘ধরে নিয়েছিলাম, এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যাব’
‘পাহাড়ের ওপরে বসে আছি চুপচাপ। দীর্ঘদিন পর প্রকৃতির মধে৵ শান্তিমতো নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি, পা বেয়ে রক্ত ঝরছে। মনে হলো, বিষধর সাপের কামড় হতে পারে। ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমাকে নিয়ে আতঙ্কিত সবাই। আমিও ধরে নিলাম, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মারা যাব।’ বলছিলেন মৌসুমী হামিদ।
১৫ আগস্ট থেকে বান্দরবানে শুটিং করছিলেন মৌসুমী হামিদ। মাসখানেক কোনো শুটিং না করায় অপেক্ষায় ছিলেন ফেরার। তাই প্রস্তাব পেতেই রাজি হয়ে যান। বিরতি আগেও নিয়েছিলেন মৌসুমী।
তাই প্রশ্ন ছিল, এবারের ফেরায় কেন জোর দিলেন? ‘পুরো এক মাস আতঙ্কে দিন কেটেছে। চোখের সামনে গুলিতে মানুষ মরতে দেখেছি, পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে দৌড়ে পালিয়েছি। প্রতিদিন মৃত্যুর খবর। মানুষের ওপর নির্বিচার হামলা, গুলি—মানসিকভাবে ঠিক ছিলাম না। শিল্পী হিসেবে অন্যায় মেনে নিতে পারিনি। এরপর কাজে ফেরাটা তো অবশ্যই অন্য রকম।’ বললেন মৌসুমী হামিদ।
পুরো এক মাস আতঙ্কে দিন কেটেছে। চোখের সামনে গুলিতে মানুষ মরতে দেখেছি, পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে দৌড়ে পালিয়েছি। প্রতিদিন মৃত্যুর খবর। মানুষের ওপর নির্বিচার হামলা, গুলি—মানসিকভাবে ঠিক ছিলাম না।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে মৌসুমী ছুটেছেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে শাহবাগ, শহীদ মিনারেও। আন্দোলন কেন টেনেছিল তা জানালেন এভাবে, ‘ন্যায্য দাবির কারণে এবং শিল্পী হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ছুটে গেছি। মাঠে থেকেছি। এখন আমাকে কেউ কেউ বলেন, আমি নাকি দালাল! কারণ, আমি ফেসবুকে কোনো ছবি পোস্ট করিনি।’
‘যাঁরা মনে করছেন, আমি নীরব ছিলাম, তাঁরা জেনে রাখুন, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে ১৩ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম।’মৌসুমী হামিদ
মন খারাপ করে মৌসুমী বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, প্রচারের কিছু নেই। এখন মনে হচ্ছে, ছবিগুলো পোস্ট করতে হবে। যাঁরা মনে করছেন, আমি নীরব ছিলাম, তাঁরা জেনে রাখুন, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে ১৩ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরে বেশ কিছু জায়গায় লুট ও চুরির ঘটনা ঘটে—এসব মৌসুমী হামিদকে মর্মাহত করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষতির ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। মানসিক অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময়ই মিউজিক্যাল ফিল্মের প্রস্তাব পান। তাই দেরি করেননি। ১৫ আগস্ট থেকে টানা শুটিং করেন। ফাঁকে নিজেকে সময়ও দিয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে ঘুরেছেন পাহাড় ও নদীতে।
শুটিংয়ে বা ঘুরতে গিয়ে আগেও পাহাড়ে যেতেন মৌসুমী। গভীর পাহাড়ে কখনোই যাওয়ার সময় হতো না। ট্রেকিং তো দূরের কথা, এ নিয়ে মন খারাপও হতো। মনে হতো, প্রকৃতির অনেক কিছুই দেখা হলো না। সেই আফসোস দূর হয় চিত্রনাট্যকার সাইয়িদ রানার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের পরে। বিয়ের পরে মৌসুমী জানতে পারেন, সাইয়িদ ট্রেকিং করতে ভালোবাসেন। এরপর শুরু হয় দুজনের পাহাড়প্রেম। ঘুরতে গেলেই এখন পাহাড়ি প্রকৃতিই প্রথম পছন্দ। এবারও সঙ্গে ছিলেন স্বামী।
মৌসুমী হামিদ বলেন, ‘সময় পেলে তাই প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমাদের প্রেমেরও শুরু। এবারও শুটিংয়ের পাশাপাশি বান্দরবানের অনেক নতুন জায়গায় গেছি। আলাদা করে ট্রেকিং করার দরকার হয়নি।’
গত সোমবার বিকেলে বান্দরবানে পাহাড়ে বসে ছিলেন মৌসুমী। বাতাস ও মেঘের মধ্যে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেন। এরই মধ্যে বুঝতে পারেন, পায়ে কোনো কিছুর কামড়। পাহাড় থেকে হাসপাতালে যেতে বেশি সময় লাগবে।
কত কঠিন মৃত্যু দেখে এসেছি, তার চেয়ে এটা শান্তির। আমি সুন্দর একটি বিকেল দেখছি, আকাশে মেঘ। দারুণ বাতাস বইছিল। এই প্রকৃতি আমার ভীষণ পছন্দের। এদিকে সবাই ভয়ে তটস্থ। আমিই শুধু মানসিকভাবে শক্ত ছিলাম
মৌসুমী বলেন, ‘ভেবেছিলাম মারা যাব। হাসপাতালে নিতে চাইলে তাই যাইনি। তখন বারবার মনে হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কথা। কত কঠিন মৃত্যু দেখে এসেছি, তার চেয়ে এটা শান্তির। আমি সুন্দর একটি বিকেল দেখছি, আকাশে মেঘ। দারুণ বাতাস বইছিল। এই প্রকৃতি আমার ভীষণ পছন্দের। এদিকে সবাই ভয়ে তটস্থ। আমিই শুধু মানসিকভাবে শক্ত ছিলাম। ৫ থেকে ১০ মিনিট পর্যবেক্ষণ করি। শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় পরে নিচে গিয়ে ধুয়ে দেখি, রক্ত এক জায়গা থেকে বেশি বের হচ্ছে। তখন ভয়মুক্ত হই। ক্ষতস্থান দেখে ধারণা করা হয়, জোঁক লেগেছিল। কী বলব, প্রকৃতি আমাকে ভয় থেকে মুক্ত করে।’
মৌসুমী হামিদ স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা জীবনের গান-এ শুটিং করেছেন। বানিয়েছেন তাসনোভা তাবাসসুম। মৌসুমী বলেন, ‘আমি একাই অভিনয় করেছি। শুটিং করতে এসে জীবনে এই প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর গল্পটিও—মানুষ শেষনিশ্বাস ত্যাগের আগে বাঁচতে চায়।’ এদিকে নয়া মানুষ সিনেমাটি মুক্তির অপেক্ষায় আছে বলে জানান এই অভিনেত্রী।