একসময় দেখি, মা গাড়ির মধ্যে কাঁদছেন...

তানিয়া বৃষ্টি। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বয়স তখন ১০ কি ১২। তানিয়া বৃষ্টি তখনই সবাইকে বলতে শুরু করেন, ‘আমি অভিনেত্রী হব।’ শুনে পরিচিতজনদের অনেকে নাক সিটকেছেন, কেউ কেউ আবার দু-চার কথা শোনাতে ছাড়েননি। তবে সেগুলোতে কান দিতেন না বৃষ্টি। কারণ, মা-বাবা তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁরা উৎসাহ দিয়ে বলতেন, ‘অন্যের কথায় কান দিয়ো না, নিজের কাজ করো।’ সেই প্রেরণাই তাঁকে এগিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ চেষ্টার পর তাঁকে নিয়েই এখন নাট্যাঙ্গনে আলোচনা, ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে তাঁরই নাটক। মোশাররফ করিম থেকে শুরু করে অনেক সহকর্মী ও পরিচালক অভিনয়ের প্রশংসা করছেন।

অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন, জানতে চাইলে তানিয়া বলেন, ‘টেলিভিশনে তখন অনেক নাটক দেখতাম। জয়া আপু, জেনি আপু, ঈশিতা আপুসহ অনেকের অভিনয় ভালো লাগত। তাঁদের পর্দায় দেখে আমারও খুব ইচ্ছা হতো তাঁদের মতো অভিনয় করার। দর্শক আমাকে পর্দায় দেখবেন। এভাবেই শুরু। পরে নাচ, গান ও অভিনয়ে প্রস্তুতি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ২০১২ সালে “ভিট চ্যানেল আই টপ মডেল”-এ যোগ দিয়ে রানারআপ হই। শুরু হয় মিডিয়ায় পথচলা।’

তানিয়া বৃষ্টি। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

তানিয়া ভেবেছিলেন, এরপর পথচলা সহজ হবে। কিন্তু আসলে পথটা যে মোটেও সহজ নয়, দ্রুতই তা বুঝে যান। এর মধ্যে কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রে সুযোগ হয়। ২০১৩ সালে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। তখন কিছু নাটকের গল্পে তানিয়াকে দেখা যেত উচ্চ স্বরে কথা বলতে বা ঝগড়া করতে। পরে এটাই তানিয়ার ট্রেডমার্ক হয়ে যায়। ‘ঝগড়াটে চরিত্র’ হলেই তাঁর ডাক পড়ত। এ প্রসঙ্গে তানিয়া বলেন, ‘একই রকম চরিত্রে অভিনয় করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। কী করব, টিকে থাকতে ১০টার মধ্যে ৬টা করেছি, কিন্তু পুরোপুরি বাদ দিতে পারিনি। দিন দিন পরিচালকেরা আমাকে ওই ধরনের চরিত্রের মধ্যেই আটকে ফেলেন। এসব চরিত্র থেকে বের হয়ে গল্পপ্রধান চরিত্রের জন্য হাঁসফাঁস করতাম, যেখানে প্রাণ খুলে অভিনয়ের সুযোগ আছে। অবশেষে গত বছর মোশাররফ করিম ভাইয়ের সঙ্গে পিনিকেই ঝিনিক নাটকে কাজ করি। গৃহকর্মীর চরিত্র। স্বামী নেশা করে, তাকে নিয়েই মেয়েটির সংগ্রাম। প্রেম ও কমেডি নাটকের ভিড়ে চরিত্রপ্রধান গল্পটি অনেকেই পছন্দ করেন। তখন থেকে দু-একজন আমাকে নিয়ে ভিন্ন গল্পে ভাবতে থাকেন।’

গত ঈদুল ফিতর ও পরবর্তী সময়ে ছোবল, লতিফ দপ্তরি, আইসিইউ, সব দোষ হোসেন আলীর, কাছের মানুষ, জায়গায় খায় জায়গায় ব্রেক নাটকগুলোতে এক নতুন তানিয়াকে খুঁজে পান দর্শক। গল্পগুলোতে মাদক, অন্তঃসত্ত্বা নারীর সমস্যাসহ নিম্নবিত্ত মানুষের কথা উঠে এসেছে। এসব নাটকও কোটি ভিউয়ে নাম লেখাচ্ছে।

নাটকটি দিয়ে এখনো প্রশংসা পাচ্ছেন এই অভিনেত্রী। ছবি: ফেসবুক

তানিয়া বলেন, ‘১০ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। কিন্তু এবারের মতো  প্রশংসা কখনো পাইনি। এই চরিত্রগুলোর জন্যই এত দিন অপেক্ষা করেছি। এখন মানসিক শান্তি পাচ্ছি। মনের বিরুদ্ধে আর অভিনয় করতে হয় না। ঈদের পর অনেক পরিচালক ফোন দিয়ে শুভকামনা জানাচ্ছেন। শিডিউল চাচ্ছেন। এবারের ঈদ আমার টার্নিং পয়েন্ট। এই ভালোবাসা আমি ধরে রাখতে চাই।’

অভিনয় ক্যারিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ, হয়তো এখানে সফল না-ও হতে পারতেন, তখন কী করতেন, এমন প্রশ্নে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘মোশাররফ করিম ভাইয়ার সঙ্গে প্রথম অভিনয় করি আমি বাবা হতে চাই নাটকে। সেদিন খুবই নার্ভাস ছিলাম, ভয়ে কাঁপছিলাম। এত বড় একজন তারকা। তার ওপর শুরুতেই ছিল ঝগড়ার দৃশ্য। ডায়ালগ উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছিল। পরিচালক মুরসালিন শুভসহ সবাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, “ভয়ের কিছু নেই, মোশাররফ ভাই ফ্রেন্ডলি মানুষ।”

অভিনয়ের টাকায় কেনা গাড়ির সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন এই অভিনেত্রী
ছবি: ফেসবুক

শুটিং করতে গিয়ে ভাইয়ের স্নেহ পেলাম। তিনি প্রথম দৃশ্য শেষে বললেন, “তুমি ভালো করবা।” ভরসা পেলাম। তিনিই আরেক দিন স্নেহ করে বললেন, “কখনোই হাল ছেড়ো না। অভিনয়কে জাপটে ধরে রাখবা। ৫, ১০ বা ১৫ বছর পর হলেও সফলতা আসবে।” এই কথাগুলোই আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছে।’

এখন নিজের মতো করেই সব চরিত্রে অভিনয় করে যেতে চান। নিয়মিত শিখতে চান। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সব সময় প্রেরণা দিয়েছেন, তাঁরা এখন তানিয়ার সাফল্যে কতটা খুশি? অভিনেত্রী বলেন, ‘অভিনয় করে নিজের টাকায় গত মাসে গাড়ি কিনেছি। সেই গাড়িতে মাকে উঠিয়ে ঘুরলাম। একসময় দেখি, মা গাড়ির মধ্যে কাঁদছেন। মেয়ের সাফল্যের এই কান্না আমার অর্জন।’

মায়ের সঙ্গে তানিয়া বৃষ্টি। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে