৫০০ তো দূর, শত পেরোতেই হিমশিম
দেশের বেশির ভাগ টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটক শততম পর্বের গণ্ডি পেরোতে পারছে না। অনেক নাটকই হুটহাট শেষ হচ্ছে। চ্যানেলের ভাষায়, এই এক শ পর্ব বলতে বোঝায় ১০৪ পর্বের স্লট। নাটক–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক অভিনয়শিল্পী ধারাবাহিকে অভিনয় করতে চান না। তা ছাড়া কেউ ধারাবাহিকের চেয়ে একক নাটক বা ওটিটির কাজ পেলে শিডিউল ফাঁসিয়ে চলে যান। তৈরি হয় জটিলতা। তখন লোকসান পোষাতে গল্পে ছাড় দিতে হয় নির্মাতাকে। তা ছাড়া ধারাবাহিকের বাজেট কম থাকে। বদল এসেছে দর্শকদের রুচিতেও। দীর্ঘ সময় ধরে একই ধারাবাহিক দর্শক দেখতে চান না। তবে এসব পাশ কাটিয়েও বেশ কিছু ধারাবাহিক নাটক সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব নাটক–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিকের দর্শক এখনো আছে।
এখন বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল প্রথমে ২৬ বা ৫২ পর্বের নাটকের অনুমোদন দেয়। জনপ্রিয়তা পেলে পরে পর্বসংখ্যা বাড়ানো হয়। এভাবেই তৈরি হয়েছিল ‘গুলশান অ্যাভিনিউ’, ‘গ্র্যাজুয়েট’, ‘হাউসফু, ‘চলিতেছে সার্কাস, ‘চাঁদের নিজের কোনো আলো নেই, ‘অলসপুর’, ‘বকুলপুর’, ‘১০০তে এক শ, ‘সাতটি তারার তিমি, ‘দ্য গুড দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি, ‘নোয়া শাল, ‘লেডিস ফার্স্ট, ‘চিটিং মাস্টার’, ‘ফুল এইচডি ফ্যামিলি ‘ক্রাইসিসসহ একাধিক নাটক। এখনো আগের নিয়মেই চ্যানেলগুলো কাজ দেয়। তাহলে বর্তমান ধারাবাহিকগুলো কেন শত পর্ব পেরোতে পারছে না, জানতে চাইলে পরিচালক মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, ‘আমরা যখন দীর্ঘ ধারাবাহিক বানিয়েছি, তখন চ্যানেলই বারবার তাগাদা দিয়েছে পর্ব বাড়াতে। আমার সব ধারাবাহিক নিয়েই ২৬ পর্বের প্ল্যানিং থাকে। পরে দর্শকপ্রিয়তা পেলে চ্যানেল থেকে পর্ব বাড়ানোর চুক্তি করি। কিন্তু এখন সমস্যা হলো, বেশির ভাগ তারকাই ধারাবাহিকে অভিনয় করতে চান না। যাঁরা করেন, তাঁরাও কয়েক পর্বের পর ঠিকমতো সময় দিতে চান না। তখন একটা শুটিং নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। এদিকে চ্যানেল ফিড ব্যাকের অপেক্ষায় বসে থাকে। এমন পরিবেশে শুটিং করলে নাটকের মান কমতে থাকে। তখন চ্যানেল দর্শক ধরতে নাটকের পর্ব বাড়ায় না।’
তবে প্রাথমিকভাবে ২৬ পর্বের চুক্তি হলেও বেশির ভাগ নির্মাতা প্রথম দিকে নির্মাণ ব্যয় বেশি করে ফেলেন। যে কারণে তাঁরা মানসিকভাবে এক শ পর্বের প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। কিন্তু নাটকটি টেলিভিশন বা ইউটিউবে সাড়া না পেলে চুক্তিমতো পর্বেই শুটিং বন্ধ করে দিতে বলে চ্যানেল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলেন, ‘ভালো গল্প, একঝাঁক শিল্পী দিয়ে নাটক নির্মাণ করেছি। তারপরও চ্যানেল পর্ব বাড়াতে চায়নি। তারা বলেছিল নাটকের রেসপন্স নেই। কিন্তু টেলিভিশনে ভালো যাচ্ছিল। পরে কিছু অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করে। শুটিং করতে গিয়ে ঋণে পড়ে অযৌক্তিক শর্ত মেনে নিয়ে কাজ করেছি।’ চ্যানেল সূত্রে জানা যায়, ‘করোনার পর বিবাহ হবে’, ‘সংসার’, ‘হইচই পরিবার’, ‘ফ্যামিলি ফ্রেন্ডস’সহ একাধিক নাটক শত পর্বের মধ্যেই শেষ হয়েছে।
অনলাইনের এই যুগে নানামুখী প্রচারমাধ্যমের কারণে দর্শক দিন দিন টিভি নাটক কম দেখছেন, এমনকি দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটক দেখতে চাচ্ছেন না বলে জানালেন বাংলাভিশনের অনুষ্ঠানপ্রধান তারেক আকন্দ। তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিক নিয়ে আমাদের নিজস্ব স্টাডি রয়েছে। এখন নাটক ইউটিউবে, ফেসবুক, ওটিটিসহ মাল্টি পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিটা মাধ্যমের মিলিয়ে আমাদের লাভ–ক্ষতির হিসাব করতে হয়। দেখা যায়, ৩ থেকে ৬ লাখ টাকা বাজেটের এক ঘণ্টার নাটকের সঙ্গে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্বের ধারাবাহিক দিয়ে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। বাধ্য হয়েই আমরা বেশি পর্বের নাটক নির্মাণ করতে চাচ্ছি না।’ এই চ্যানেলের ‘গুলশান অ্যাভিনিউ-২’ ছাড়া খুব কম নাটকই এক শ পেরোতে পেরেছে।
একটা সময় ছিল ধারাবাহিক নিয়ে নির্মাতা, প্রযোজক, শিল্পী কলাকুশলীদের আলাদা পরিকল্পনা থাকত। কীভাবে দর্শক ধরে রাখা যায়, কীভাবে গল্পের প্রতিটা দৃশ্যে চমক রাখা যায়—এসব নিয়ে ভাবতেন নির্মাতা। শিল্পীদের আগেই চিত্রনাট্য পাঠানো হতো। যে কারণে নাটকগুলো নিয়ে আলাদা আগ্রহ থাকত দর্শকদের উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘আমার প্রতিটা ধারাবাহিক গল্প যেখানে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল, ঠিক সেখানেই শেষ করেছি। চাইলে তো হাজার পর্ব করতে পারতাম।’ বর্তমানে ৫০০ পর্ব পেরোনো নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘মাশরাফি জুনিয়র’ ও ‘মান অভিমান’। ‘মাশরাফি জুনিয়র’ নাটকের পরিচালক সাজ্জাদ সুমন বলেন, ‘শুরুতে ২৬ পর্বের পরিকল্পনা ছিল। দর্শক চাহিদার কারণে বেড়ে হয়তো হাজার পর্বে যাবে। দর্শক ধরে রাখতে আমরা প্রথম থেকে প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি দৃশ্য নিয়ে ভেবেছি। গল্প নিয়ে টিমের সবার সঙ্গে পরিকল্পনা করি। ভালো কাজ হলে দর্শকদের কাছে পৌঁছাবেই। চ্যানেল তখন অবশ্যই চাইবে পর্ব বাড়াতে।’