হুমায়ূন ভাইয়ের দুই চোখের কোনায় পানি, বুকটা হু হু করে উঠল...
হুমায়ূন আহমেদের নাটক দিয়ে পরিচিতি পাওয়া। সেই সূত্রেই সম্পর্ক। এরপরে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে হুমায়ূন আহমেদের সংস্পর্শে। এখনো নানা উপলক্ষে প্রায়ই প্রিয় মানুষের কথা ভাবেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। এবারও বৃষ্টিতে মনের কোণে একাধিকবার ঘুরেফিরে আসছিল প্রিয় মানুষটি, যা তাঁকে নুহাশপল্লিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। যেখানে বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন এই অভিনেতা।
অভিনেতা ফারুক আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, বৃষ্টি হলেই হুমায়ূন আহমেদের কথা বেশি মনে পড়ে। তুমুল বৃষ্টি তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। এককথায় তিনি ছিলেন বৃষ্টিবিলাসী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কাটানো কোনো সময়ের কথাটা এখন বেশি মনে পরে? এমন প্রশ্নে এই অভিনেতা জানালেন, শেষ বছরটি। হুমায়ূন আহমেদ কর্কট রোগে আক্রান্ত। আমেরিকায় কয়েকটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। পরে তিনি দেশে এসে ১৫ দিনের নুহাশপল্লিতে ছুটে যান।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমি হুমায়ূন ভাইকে দেখতে নুহাশপল্লি যাব। এর মধ্যে নুহাশপল্লি থেকে ফোন এল হুমায়ূন ভাই নতুন নাটক নির্মাণ করবেন। আমি অবাক। একজন মানুষ কর্কট রোগে আক্রান্ত অথচ কী তাঁর প্রাণশক্তি। পরদিন সকালবেলা আমি ছুটে গেলাম নুহাশপল্লি। গিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাই ড্রয়িংরুমে বসে অনেকের সঙ্গে নাশতা করছেন।’
এই অভিনেতা ভেবেছিলেন প্রিয় ব্যক্তিকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখবেন। কিন্তু না। হুমায়ূন আহমেদকে দেখে আগের মতোই মনে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে দেখে ডাকলেন। নাশতা করতে বললেন। ‘আমি তাঁর কথায় বিস্মিত। একজন অসুস্থ মানুষ, কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নাই। আমি নাশতা খেতে তাঁর পাশে বসলাম। তিনি এক টুকরা আম নিয়ে চুষতে লাগলেন। তারপর আমেরিকার গল্প শুরু করলেন। ট্রিটমেন্টের সময় আমেরিকার ডাক্তারদের সঙ্গে কী কী মজার ঘটনা ঘটেছে, সেই সব গল্প।’ -বলেন ফারুক আহমেদ।
এরপরে শুরু হলো নাটক নিয়ে কথাবার্তা। এই অভিনেতা জানান, হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে জানালেন, ‘পিপীলিকা’ নামে একটি নাটক বানাবেন। কাল থেকেই শুটিং। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান ফারুক আহমেদ।
পরদিন থেকে নাটকের শুটিং শুরু হলো। শুটিংয়ের সেই আগের মতোই আড্ডা জমে উঠল। আগের মতোই মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন ফারুক আহমেদ। ‘হুমায়ূন ভাইয়ের গল্প বলার ঢং ঠিক আগের মতো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় না তিনি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত।’ বলেন ফারুক আহমেদ।
এরপরে শুটিং শেষ হয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রিয় লিচুগাছের নিচে বসে, গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। ডালে ডালে পাকা লিচু ঝুলছে। পাশে বসে আছেন ফারুক। তাঁকে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ‘নুহাশপল্লির কেয়ারটেকার মোশারফকে ডাকতে। এরপরে যেন সেই আগের মতোই নানা মজার ঘটনার জন্ম দেন এই লেখক ও পরিচালক।
ফারুক আহমেদ জানান, হুমায়ূন আহমেদ সেই মোশারফকে, গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তাঁর কাছে নিয়ে আসার কথা বলেন। সময় দেন ২৫ মিনিট। ‘আমি হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে চুপ চাপ বসে রইলাম। হুমায়ূন ভাই একসময় কথা শুরু করলেন, “কি আশ্চর্য তাই না ফারুক! এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বই মেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায়রে জীবন! আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। এক সময় লক্ষ করি হুমায়ূন ভাইয়ের দুই চোখের কোনায় পানি, আমার বুকটা তখন হু হু করে উঠল। কিছু বলতে পারলাম না।’
কিন্তু শিশু কিশোরদের আনতে দেরি হয়ে যায়। তারপরও গেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। একসময় নুহাশপল্লির গেট দিয়ে ১২-১৪ জন ছেলেমেয়ে প্রবেশ করে। এই শিশুদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন লেখক। সবাইকে অবাক করে হুমায়ূন আহমেদ শিশুদের কাছে জানতে চান, শিশুরা কে কে গাছে উঠতে পারে। প্রায় সবাই হাত তুলে সায় দিল।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সেদিন দেরি না করে, তখনই হুমায়ূন ভাই শিশুদের বললেন, “তোমরা এই লিচু গাছে উঠবে। তারপর যত পারো লিচু খাবে। আমি ওয়ান, টু, থ্রি বলব তোমারা লিচুগাছে ওঠা শুরু করবে। ঠিক আছে?” তিন বলতেই শিশুরা মাঝারি সাইজের লিচুগাছে উঠে লিচু খাওয়া শুরু করল। হুমায়ূন ভাই অবাক হয়ে শিশুদের লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন। গাছের পাকা লিচু তারা খাচ্ছে আর হইচই করছে। কেউ আবার পকেটে ভরছে। যে কয়জন গাছে উঠতে পারে না তাদের জন্য নিচে ফেলছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।’
সবশেষে ফারুক আহমেদ আরও বলেন, ‘সেদিন হুমায়ূন ভাই এক সময় আমাকে বললেন, “এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখন দেখেছ? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনো ভাবে পাওয়া যায়?”’
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না। হুমায়ূন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোন ফারুক একে বলে আকাশ সমান ভালো লাগা। একে বলে আকাশছোঁয়া ভালোবাসা।’