১ নম্বরে ‘শ্বশুরবাড়িতে ঈদ’, যে ১০ নাটক সবচেয়ে বেশি দেখেছেন দর্শক
নাটকের জন্য বছরের শুরুটা শুভ হলেও শেষটা ভালো ছিল না। বছরের মাঝামাঝি জুলাই অভ্যুত্থানকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে শিল্পীসমাজ, রাজনৈতিক পালাবদলের পর একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় শুটিং। এখনো নিয়মিত কাজে ফেরেননি প্রযোজক-শিল্পীর অনেকে। কমেছে নাটকের আয় ও বাজেট। নাটকের জন্য বছরটা কেমন ছিল, সেটিই ফিরে দেখলেন মনজুরুল আলম
গত দুই–তিন বছরে নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। একসময় টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে নাটক প্রচারের কথা ভাবাই যেত না, সেই নাটক এখন সরাসরি মুক্তি পাচ্ছে ইউটিউবে। ফলে নাটকের ইন্ডাস্ট্রি বড় হচ্ছে। গড়ে উঠেছে শতাধিক ইউটিউব চ্যানেল। টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেলগুলো নাটকের বাজেট বাড়াচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করছে। সেই বৈদেশিক আয় দিয়ে বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত রেকর্ড গড়েছিলেন ইউটিউব চ্যানেলের প্রযোজকেরা।
যে নাটকগুলো বেশি দেখছেন
বছরের শুরু থেকেই দর্শক কমেডি ও রোমান্টিক গল্পের নাটক বেশি দেখেছেন। বেশি দেখা নাটকগুলোর মধ্যে ছিল ‘শ্বশুরবাড়িতে ঈদ’, ‘মামার বাড়ি’, ‘চাচা ভাতিজা জিন্দাবাদ’, ‘বান্ধবীর ভাই’ ইত্যাদি। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্বশুরবাড়িতে ঈদ নাটকের গল্পে উঠে এসেছে শ্বশুরবাড়িতে ঈদকে ঘিরে মজার সব ঘটনা। কোনো গল্পে আবার উঠে এসেছে সামাজিক বাস্তবতা। এর মধ্যে ‘মামার বাড়ি’ নাটকটি সবচেয়ে বেশি দেখা নাটকের তালিকায় ২ নম্বরে রয়েছে।
শীর্ষ ১০ নাটক
শ্বশুরবাড়িতে ঈদ (নিলয়-হিমি)
মামার বাড়ি (নিলয়-হিমি)
চাচা ভাতিজা জিন্দাবাদ (নিলয়-হিমি)
বান্ধবীর ভাই (নিলয়-হিমি)
শুধু তোমার জন্য (মুশফিক আর ফারহান-কেয়া পায়েল)
জামাই বউর মাথা গরম (মোশাররফ করিম-তানিয়া বৃষ্টি)
লাভ লাইন (জোভান আহমেদ জোভান-নাজনীন নেহা)
আমার হয়ে থেকো (মুশফিক আর ফারহান-সাদিয়া আয়মান)
একবার বলো ভালোবাসি (মুশফিক আর ফারহান-নাজনীন নীহা)
তুই আমারই (মুশফিক আর ফারহান-সাদিয়া আয়মান)
(ইউটিউব ভিউর হিসাবে,২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত )
এর গল্প মামার বাড়িতে মায়ের সম্পদ ভাগ করাকে কেন্দ্র করে। কমেডির বাইরে নাটকে ভিন্নভাবে দেখা যায় নিলয় ও হিমিকে। ভিউ দিয়ে এ বছর এগিয়ে ছিলেন পরিচালক মুহিন খান, তাইফুর জাহান আশিক, প্রবীর রয় চৌধুরী, মিফতা আনান, তৌফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
ভিউয়ে এগিয়ে কোন তারকারা
নাটকের ভিউ মানেই সবার আগে চলে আসে অভিনয়শিল্পী জুটি নিলয় আলমগীর ও হিমির কথা। তিন বছর ধরে অভিনেত্রী হিমি–নিলয়ের নাটক অঙ্গনে আলোচিত জুটি গড়ে। এখন ৮০ ভাগের বেশি নাটকে তাঁদের একসঙ্গে দেখা যায়। বছরের সবচেয়ে বেশি ভিউ পাওয়া ১০ নাটকের মধ্যে প্রথম চারটি নাটকের জুটিই তাঁরা। এ ছাড়া কয়েকটি নাটকে মুশফিক আর ফারহানের সঙ্গে অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মানকে দেখা গেছে। তাঁদের ‘আমার হয়ে থেকো’ ও ‘তুই আমারই’ দর্শক বেশি দেখেছেন। নাটকগুলো ইউটিউবে শীর্ষ দেখা ১০ নাটকের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া ফারহানের সঙ্গে নাজনীন নীহার ‘একবার বলো ভালোবাসি’ নাটকটি ভিউয়ে শীর্ষ ৯–এ আছে। কেয়া পায়েল অভিনেতা ফারহানের সঙ্গে ‘শুধু তোমার জন্য’ নাটকে জুটি বেঁধে ছিলেন; সেটাও আলোচনায় ছিল। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে নাটক দিয়ে আলোচনায় থাকেন মোশাররফ করিম। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি, এই অভিনেতার ‘জামাই বউর মাথা গরম’ নাটকটি দর্শকেরা পছন্দ করেছেন। তাঁর সহশিল্পী ছিলেন তানিয়া বৃষ্টি। ভিউয়ের হিসাবে ফারহান আহমেদ জোভান ও নাজনীন নীহার ‘লাভ লাইন’ রোমান্টিক গল্পটি দর্শকদের পছন্দের তালিকায় ছিল। এর বাইরে জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, তৌসিফ মাহবুব, খায়রুল বাসার, ইয়াশ রোহান, শামীম হাসান সরকারদের নাটক দর্শকেরা বেশি দেখেছেন।
ধারাবাহিক ছিল তারকাশূন্য
বর্তমান সময়ে টেলিভিশন নাটকের প্রতি বেশির ভাগ দর্শকের অনীহা রয়েছে। টেলিভিশনে প্রচারের পরে নাটক ইউটিউবে মুক্তি পেলেই তারকা কলাকুশলীরা সবচেয়ে বেশি সাড়া পান। বিজ্ঞাপন বিরতির ঝামেলা, পছন্দমতো সময়ে নাটক দেখাসহ নানা সুবিধার জন্য ইউটিউবকেই দর্শকেরা নাটক দেখার প্রধান প্ল্যাটফর্ম ধরে নিয়েছেন। যে কারণে টেলিভিশনের চেয়ে ইউটিউব নাটকের দিকে অভিনয়শিল্পীদের ঝোঁক বেশি। একই কারণে টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলোও মান হারাচ্ছে। যে ধারাবাহিক নাটক দিয়ে একসময় তারকা তৈরি হয়েছে, সেই ধারাবাহিক এখন তারকাশূন্য। একসময় মোশাররফ করিমকে বছরে টানা চার–পাঁচটি ধারাবাহিকে দেখা গেলেও এখন বছরে খুব বড়জোর এক–দুটো ধারাবাহিকে দেখা যায়। বেশির ভাগই এখন এক ঘণ্টার নাটক নিয়ে ব্যস্ত। এ ছাড়া নাটকপাড়া দাপিয়ে বেড়ানো জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, তৌসিফ মাহবুব, ফারহান আহমেদ জোভান, মুশফিক আর ফারহান, ইয়াশ রোহান, সাবিলা নূর, তাসনিয়া ফারিণ, অহনা রহমান তানিয়া বৃষ্টি, কেয়া পায়েল, তটিনীসহ ভিউ রয়েছে এমন ৯০ ভাগের বেশি শিল্পীকেই ধারাবাহিকে দেখা যায় না।
আন্দোলনের পক্ষে–বিপক্ষে তারকারা
করোনার কারণে শুটিং বন্ধ ছিল। তবে সেই সময়েও অনেকে সচেতন হয়ে শুটিং করেছেন; কিন্তু এবার জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে শুটিং বন্ধ থাকে। একাধিক অভিনয়শিল্পী শুটিংয়ে গিয়ে ফিরে এসেছেন।
মানসিকভাবে দেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদে একসময় ঘর থেকে বের হন তারকারা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীরা সোচ্চার হন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ছোট পর্দার অনেক অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলী। নাটকের নানা সংলাপ ভাইরাল হওয়া মোশাররক করিমের মুখে আন্দোলনের সময় ভাইরাল দেশের পাশে থাকার বার্তা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে যে অবস্থা বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমরা ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থায় নেই। আমরা শান্তি চাই। রক্ত দেখতে চাই না।’
শেষটা ভালো ছিল না
স্বৈরাচার সরকার পতনের পরে দেশের দর্শকেরা একেবারেই নাটক দেখা কমিয়ে দেন। যে নাটক ট্রেন্ডিংয়ের একের পর এক জায়গা করে নিত, সেই নাটক তিন মাস ট্রেন্ডিংয়েই আসতে পারিনি। ভিউ হয়েছে হাতে গোনা। অনেকে প্রযোজক নিজেদের লগ্নি থেকে গুটিয়ে নেন। যার প্রভাবে নাটক নির্মাণ ৯০ ভাগ কমে যায়। দীর্ঘ চার মাসেও আগের অবস্থায় ফেরেনি নাট্য অঙ্গন। এখনো কাজে ফেরেননি অনেক অভিনয়শিল্পী কলাকুশলী।
প্রযোজকদের নেতা সাজু মুনতাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সব মিলিয়ে কয়েক শ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত প্রযোজকদের যাঁরা মাসে লাখ ডলার আয় করতেন, তাঁরাও মাত্র কয়েক হাজার টাকা ডলার আয় করেছেন। এখনো পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না অনেকে। যে কারণে স্বাভাবিক লগ্নিতে এখনো আমরা যেতে পারিনি। আমাদের ৪০ ভাগ কলাকুশলী এখনো বেকার। নিয়মিত কাজ নাই।