বোর্ড পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছিলেন মিতা চৌধুরী
চলে গেলেন টিভি ও মঞ্চনাটকের শিল্পী মিতা চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে আটটায় লন্ডনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন গুণী এই অভিনেত্রী। সত্তর-আশির দশকে নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ ছিলেন মিতা চৌধুরী। মঞ্চনাটকে সূক্ষ্ম অভিনয় বা টিভি পর্দায় জাঁদরেল অভিনেত্রী—সবকিছুতেই স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে যেতেন মিতা চৌধুরী। শিক্ষাজীবনেও মেধাবী ছিলেন তিনি।
এ অভিনেত্রীর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। ক্যানসারে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে।
বৃহস্পতিবার মিতা চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দিয়ে দুঃসংবাদটি দিয়েছেন কন্যা নাভিন চৌধুরী। নাভিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে মায়ের ফেসবুক থেকে লিখেছেন, ‘বন্ধুরা, আমি নবীন বলছি, ঘণ্টা দুয়েক আগে মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। অনুগ্রহ করে তার জন্য দোয়া করবেন। আমরা এই মুহূর্তে সবার মেসেজ-কলের জবাব দিতে পারব না। আমাদের মা এখন বাবার সঙ্গে পুনরায় গান গাইছেন, নাচ করছেন…।’
মিতা চৌধুরী নামে পরিচিত হলেও তিনি মিতা রহমান নাম ব্যবহার করতেন। মিতা চৌধুরী দুই সন্তান; দুই ভাই কাইজার চৌধুরী, সিজার চৌধুরীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে ক্যানসারে মারা যান তাঁর স্বামী শহীদুর রহমান। মিতা চৌধুরীর দাফন লন্ডনেই হবে বলে জানিয়েছেন ভাই লেখক কাইজার চৌধুরী।
মিতা চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শুনে শোক প্রকাশ করেছেন নন্দিত অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফাসহ অনেকে। সুবর্ণা মুস্তাফা প্রয়াত অভিনেত্রী মিতা চৌধুরীর সঙ্গে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে কাজ করেছিলেন। সেই স্মৃতি হাতড়ে সুবর্ণা মুস্তাফা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মিতাকে স্মরণ করছি। আমার প্রথম টিভি নাটক “বরফ গলা নদী”মিতার সঙ্গে ছিল। “ডলস হাউস” নাটকের সুবাদে প্রায় ২৮ বছর পর আমরা ফের পর্দায় এসেছিলাম।’ এর আগে আরেকটি শোকবার্তায় সুবর্ণা মুস্তাফা লিখেছেন, ‘প্রিয় মিতা, আমার সুন্দরী, ভালোবাসার, দুর্দান্ত মেধাবী বন্ধু, তোমাকে বিদায় বলা খুব কঠিন। তুমি তোমার জীবনের ভালোবাসা শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আবারও এক হয়েছে। এটা আসলে শুধু সময়ের ব্যাপার। শান্তিতে থাকো আমার ভালোবাসা।’
মিতা চৌধুরীর ছবি শেয়ার করে নির্মাতা, অভিনেতা কাওসার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমি ভাবতে পারছি না মিতা আপা নেই! মিতা চৌধুরী, প্রিসিলা পারভীন, রিনি রেজা, আল মনসুর, রাইসুল ইসলাম আসাদ ভাইদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। বিস্ময়ে ভাবতাম—এত এত জটিল নাটকে এত “সহজ অভিব্যক্তি”ও কি সম্ভব—পারফরমারদের পক্ষে! তাঁদেরই একজন হারিয়ে গেলেন মুহূর্তেই! আমি ভীষণ মর্মাহত! মিতা”পার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।’
মিতা চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৮ সালের ২২ জানুয়ারি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে। তাঁর বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আমিনুল হক চৌধুরী, মা নূর-ই–আক্তার বানু গৃহিণী ছিলেন। মেধাবী এই অভিনেত্রী শিক্ষাজীবনেও সফল ছিলেন। তিনি লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং হলি ক্রস গার্লস কলেজ থেকে এইএচএসসি পাস করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি এইচএসসিতে মেয়েদের মধ্যে মেধাতালিকায় প্রথম এবং সম্মিলিত মেধাতালিকায় অষ্টম হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন।
মিতা চৌধুরীকে নিয়ে দৈনিক সমকালে এক কলামে আরেক গুণী অভিনেতা আল মনসুর লিখেছেন, একজন শিল্পীকে অন্যদের সঙ্গে মূল পার্থক্য গড়ে দেয় তাঁর শৈল্পিক ভাবনা। মিতা চৌধুরী এমনই একজন শিল্পী, যাকে অনুজেরা আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধা বোধ করেন না। তাঁর শৈল্পিক ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতা সব সময় অনুপ্রেরণা জোগায়।
তিনি লিখেছেন, ‘অভিনয় নিয়ে আমার মতো তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। সে–ও সহজাত, প্রাকৃতিক শিল্পী। মিতার সঙ্গে নাটকে বেশ আন্তরিকতা নিয়েই কাজ করেছি। মনেই হয়নি শুটিং করছি। মনে হতো গেট টুগেদার। শুটিংয়ে পারিবারিক পরিবেশ বিরাজ করত। যে জন্য অভিনয় প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত হতো। সত্যি কথা বলতে গেলে, আমরা নিজেদের শিল্পী ভাবতাম না। কাজটিই ছিল আমাদের কাছে মুখ্য। অভিনয় নিয়ে বেশি ভাবতাম। ওর ভেতরের অভিনয়যোগ্যতা বা শিল্পপ্রতিভাকে ঠেলা দিয়ে কিংবা ধাক্কা দিয়ে বের করতে হয়নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা বিকশিত হয়েছে। যখন যে চরিত্রে, তখন সেই চরিত্রে অভিনয় করতে সাবলীল মনে হতো। মিতা যখন যে চরিত্রে অভিনয় করত, সেই চরিত্রটা ভেতর থেকে প্রকাশিত হতো।’
দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নাট্যজগতে কাজ শুরু করেন মিতা চৌধুরী। তিনি একসময় বিটিভিতে অভিনয় করতেন আর বেতারে খবর পড়তেন এবং ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন।
বিটিভিতে মিতা চৌধুরীর প্রথম নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর ‘আরেকটি শহর চাই’। প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘শান্ত কুটির’। ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকটির পর মিতা চৌধুরীর আলাদা অবস্থান তৈরি হয়। ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে মিতা চৌধুরীর চরিত্রের নাম ‘লিলি’। ‘নন্দিত নরকে’ তাঁর অভিনীত আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। শুধু টিভি নাটকই নয়, মঞ্চে ‘সূচনা’ ও ‘গুড নাইট মা’–এর মতো প্রযোজনায় নিজেকে জড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে ‘অমানুষ’ নাটকে মামুনুর রশীদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। মিতা চৌধুরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘বিষ’, ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।
সত্তর-আশির দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। মাঝে ২০০৬ সালে দেশে ফিরে নাটকে কাজ করেছিলেন। সে যাত্রায় প্রায় ১০ বছর ছিলেন ঢাকায়। এ সময় তাঁকে দেখা গেছে ‘ডলস হাউস’, ‘যোগ-বিয়োগ’ ইত্যাদি নাটকে। আবার ফিরে যান লন্ডনে, সেখানেই শেষ হয় তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রা।