ভিকির কাজ কেন জনপ্রিয়তা পায়

‘ইরিনা’, ‘জন্মদাগ’, ‘রেহনুমা’, ‘চিরকাল আজ’, ‘পুনর্জন্ম সিরিজ’, ‘রেডরাম’, ‘দ্য সাইলেন্স’, ‘কাজলের দিনরাত্রি’, ‘আমি কি তুমি’, ‘তিথিডোর’, ‘রুমি’—একের পর এক আলোচিত কাজ উপহার দিয়েছেন ভিকি জাহেদ। কোলাজ

থ্রিলার নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই পরিচিতি আছে ভিকি জাহেদের, সাম্প্রতিক দুই কাজ দিয়ে সে পরিচয় যেন আরও পোক্ত হলো। গত ঈদে তাঁর মুক্তি পাওয়া নাটক ‘হাজত’; আর গত বুধবার বিঞ্জে আসা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা একটি ‘খোলা জানালা’র প্রশংসা চলছে অন্তর্জালে।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘একটি খোলা জানালা’র পোস্টার থেকে। বিঞ্জের ফেসবুক থেকে

মোটাদাগে দুই কনটেন্টের মিলও আছে—দুটিই থ্রিলার, দুটিই এক রাতের, এক লোকেশনের গল্প। এক লোকেশনে দর্শককে আটকে রাখা সহজ নয়; কিন্তু নির্মাণের মুনশিয়ানায় সেই চ্যালেঞ্জে উতরে গেছেন ভিকি। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে নিজের কাজ ও প্রেরণা নিয়ে কথা বলেছেন এই তরুণ নির্মাতা, দিয়েছেন সমালোচনার উত্তরও।

সাফল্যের তিন কারণ
‘ইরিনা’, ‘জন্মদাগ’, ‘রেহনুমা’, ‘চিরকাল আজ’, ‘পুনর্জন্ম সিরিজ’, ‘রেডরাম’, ‘দ্য সাইলেন্স’, ‘কাজলের দিনরাত্রি’, ‘আমি কি তুমি’, ‘তিথিডোর’, ‘রুমি’—একের পর এক আলোচিত কাজ উপহার দিয়েছেন ভিকি জাহেদ; তবে থ্রিলারের জন্য বেশি পরিচিতি তাঁর। কেবল থ্রিলার নয়, সায়েন্স ফিকশন থেকে শুরু করে এমন অপ্রচলিত বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, যা দেশি কনটেন্টে খুব একটা দেখা যায় না।

ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। আমার নিজের অনেক চিন্তা বদলে গেছে, অনেক কিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। এটা সব মানুষের ক্ষেত্রেই হয়েছে। আমরা যেহেতু দৃশ্যমাধ্যম (ভিজু৵য়াল মিডিয়া) নিয়ে কাজ করি, আমার কাজেও এটা নিশ্চিতভাবে আসবে, সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে।’ এই নির্মাতা আরও মনে করেন, এই গণ-অভ্যুত্থান পরিসর অনেক। কোনো গল্প এখন বোঝা যাচ্ছে, কোনোটি হয়তো আরও পরে সামনে আসবে; যা সহজাতভাবেই তাঁর কাজে উঠে আসবে।
ভিকি জাহেদ

‘চিরকাল আজ’-এ তিনি পর্দায় তুলে ধরেছেন অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত এক চরিত্রের জার্নি। ‘আমি কি তুমি’র মূল উপজীব্য প্যারালাল ইউনিভার্স। তাঁর গল্পে দেখা যায় ক্রমিক খুনি, নরমাংসখাদক, জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে। এ ছাড়া তাঁর কাজে থাকে দুনিয়ার নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার রেফারেন্সও। ভিকির এই সাফল্যের রহস্য কী? নির্মাতার নিজের পর্যবেক্ষণে উঠে এল তিনটি কারণ।

ভিকি জাহেদ। নির্মাতার সৌজন্যে

‘প্রথমত, নস্টালজিয়া। আশি–নব্বই দশকে “এক্স-ফাইলস”-এর মতো অনেক সিরিজ ছিল, যেগুলো আসলে অতিপ্রাকৃত বা মিস্ট্রি-থ্রিলার ঘরানার; এসব তখন তুমুল জনপ্রিয় হয়। এ ধরনের শো এখন হয় না, আমার কাজগুলোতে সেই সময়ের শোগুলোর কিছু উপাদান থাকে; যা দর্শককে নস্টালজিক করে। আমার কাজে দর্শকেরা নিজেদের ফেলে আসা শৈশব খুঁজে পান। ইউটিউব বা ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে অনেক দর্শক সে কথা লিখেছেনও।’ বলেন ভিকি। এ ছাড়া এই নির্মাতা মনে করেন, তাঁর সঙ্গে দর্শকের একটা ‘যোগ’ আছে। ভিকির ভাষ্যে, ‘দর্শকের সঙ্গে আমার একটা সাইকোলজিক্যাল বা মেটাফিজিক্যাল যোগ আছে; আমার কাছে দর্শক কী চান সেটা বুঝতে পারি।’ এটাকে নিজের জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় কারণ বলে মনে করেন ভিকি। তৃতীয় কারণ ভাগ্য। নিরীক্ষাধর্মী কনটেন্ট বানিয়ে পরিচিতি পাওয়া পরম সৌভাগ্যবান না হলে হয় না বলে মনে করেন তিনি।

‘কোনোটা সাফল্য পায়, কোনোটা পায় না’
‘হাজত’ আর ‘একটি খোলা জানালা’ আলোচিত হলেও এর আগে ভিকির দুই ওয়েব সিরিজ রুমি ও টিকিট সেভাবে সাড়া ফেলেনি। অনেক সমালোচকের মত—অল্প বাজেটে সীমিত পরিসরে গল্প বলায় তিনি ভালো; কিন্তু ওয়েব সিরিজের মতো বড় পরিসরে নির্মিত তাঁর কাজগুলো সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না। এমন সমালোচনার কী উত্তর দেবেন? ‘এটার প্রতিক্রিয়া দেওয়া তো আমার জন্য বিপদের, পরে আর বাজেট পাব না।’ প্রশ্ন শুনে শুরুতে একটু মজা করলেন।

‘হাজত’ নাটকের পোস্টার। ফেসবুক থেকে

এরপর সিরিয়াস হয়ে ভিকি বললেন, ‘যেকোনো কনটেন্টই আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে বানাই। কোনোটা সাফল্য পায়, কোনোটা পায় না; এটা খুবই স্বাভাবিক।’ চলতি বছর মুক্তি পাওয়া টেলিফিল্ম ‘তিথিডোর’-এর উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বললেন, ‘আমরা তো ভেবেছি এটার ভিউ ১ মিলিয়নও হবে না; কিন্তু এখন তো ৫০ লাখের বেশি (গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৫৫ লাখ ২০ হাজার ৯৭) মানুষ দেখেছে। এটা ভাগ্যের ব্যাপার।’

টিভি, ওটিটি মিলিয়ে ভিকি প্রচুর কাজ করেন। এত কাজ করতে গিয়ে সব কটির মান কি ঠিক থাকে? নির্মাতা অবশ্য মনে করেন, পেশাদার নির্মাতা হিসেবে তাঁর কাজের সংখ্যা খুব বেশি না। তবে এ–ও স্বীকার করলেন, কম কনটেন্ট বানালে হয়তো আরও বেশি মনোযোগী হওয়া যেত।

বদলে যাওয়া মনোজগৎ
এর আগে কোভিড ভিকি জাহেদের মনোজগৎ পুরোপুরি বদলে দেয়। কোভিডের পর থেকেই তাঁর নির্মিত সব কনটেন্টেই দেখা মেলে ধূসর চরিত্রের। ‘কোভিডের আগের আর পরের নির্মাতা বা ব্যক্তি ভিকি আলাদা’, বললেন তিনি।

ভিকি জাহেদ। নির্মাতার সৌজন্যে

গত জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে তাঁকে প্রভাবিত করবে? ‘ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। আমার নিজের অনেক চিন্তা বদলে গেছে, অনেক কিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। এটা সব মানুষের ক্ষেত্রেই হয়েছে। আমরা যেহেতু দৃশ্যমাধ্যম (ভিজু৵য়াল মিডিয়া) নিয়ে কাজ করি, আমার কাজেও এটা নিশ্চিতভাবে আসবে, সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে।’ এই নির্মাতা আরও মনে করেন, এই গণ-অভ্যুত্থান পরিসর অনেক। কোনো গল্প এখন বোঝা যাচ্ছে, কোনোটি হয়তো আরও পরে সামনে আসবে; যা সহজাতভাবেই তাঁর কাজে উঠে আসবে।

হিচকক-প্রেরণা
ভিকি জাহেদ থ্রিলার বানান; তাই তাঁর অন্যতম প্রেরণা যে আলফ্রেড হিচকক হবেন সে আর আশ্চর্য কী। চলতি বছর হিচককের দুই আলোচিত সিনেমা ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ ও ‘রিয়ার উইন্ডো’র মুক্তির ৭০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ভিকির সঙ্গে আলাপের শেষ হয় তাই হিচকক প্রসঙ্গে। নির্মাতা জানান, রিয়ার উইন্ডোর চেয়ে ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ তাঁর বেশি প্রিয়। কারণ ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, সিনেমাটিতে দীর্ঘ সিকোয়েন্স, লম্বা লম্বা সংলাপ; তারপরও বিরক্ত লাগে না। হিচককের অনেক ছবিতে সহিংসতা আছে, ধাওয়া করার দৃশ্য আছে, রোমাঞ্চ, উত্তেজনা আছে; কিন্তু “ডায়াল এম ফর মার্ডার”-এ সেসব খুব বেশি নেই। তারপরও ছবিটি আপনাকে পর্দায় আটকে রাখে, এটাই হিচকক-জাদু।’

আরও পড়ুন

ভিকি আরও মনে করেন, হিচককের সময় প্রযুক্তি তত উন্নত ছিল না, তার বেশির ভাগ ছবিও হয়েছে স্টুডিওর মধ্যে যা থ্রিলার নির্মাতার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং; কিন্তু তাঁর গল্প বলার ক্ষমতা এমন ছিল যে এসব কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। খুব অল্প উপকরণ দিয়ে কীভাবে পর্দায় রোমাঞ্চ আর রহস্য তৈরি করা হয়, সেটা হিচককের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন ভিকি।