কাঁদলেন আবুল হায়াত, কাঁদালেন বিপাশা–নাতাশাসহ সবাইকে

আত্মজীবনী প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্ত্রীসহ কাঁদলেন আবুল হায়াত, কাঁদালেন মেয়ে বিপাশা–নাতাশাসহ সবাইকেছবি : আশরাফুল আলম

ব্যতিক্রমী একটি বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিল শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তন। মিলনায়তনে উপস্থিত অতিথিদের প্রায় সবাই একই মত প্রকাশ করলেন। নাট্যজন আবুল হায়াতের আত্মজীবনীমূলক বই ‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ থেকে নির্বাচিত গল্প উপস্থিত অতিথিদের সামনে পড়ে শোনান নাট্যাঙ্গনের পরিচিতমুখেরা। এ তালিকায় আজাদ আবুল কালাম যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন অপি করিম, দীপা খন্দকার, ইন্তেখাব দিনার, রওনক হাসান প্রমুখ। ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। শেষ দিকে অনুষ্ঠানে আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হয়। বইয়ের লেখক আবুল হায়াত স্ত্রী শিরিন হায়াতসহ মঞ্চে ওঠে কাঁদলেন, কাঁদিয়েছেন মেয়ে বিপাশা-নাতাশাসহ উপস্থিত সবাইকে।

আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আজ শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে ‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে। নাট্যজন আবুল হায়াতের আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন নাট্যাঙ্গনের অনেকেই। বাবার বই প্রকাশ উপলক্ষে বড় মেয়ে বিপাশা হায়াত উড়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রধান অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সবার বক্তব্য শেষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন আবুল হায়াত।

আরও পড়ুন
আবুল হায়াত যখন কথা বলছিলেন তখন কাঁদছিলেন তাঁর স্ত্রী শিরিন হায়াত, পাশে ছিলেন দুই কন্যা ও প্রকাশক
ছবি : আশরাফুল আলম

শুরুতে আত্মজীবনী প্রকাশ প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, ‘বইটা কেন লিখেছি, এর কোনো জবাব নেই। ১০ বছর ধরে লিখেছি। বইটা পড়লেও সবাই তা টের পাবেন। আমি নিজেও তো অনেকের বই পড়েছি। ভাবলাম, লিখি না, আমার জীবনেও তো অনেক ঘটনা আছে। বই লেখার ক্ষেত্রে যে ঘটনা আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, মুর্শিদাবাদ থেকে একটি পরিবার চট্টগ্রামে এল শুধু টেবিলে বসে একটা দাগ টানার কারণে; যখন বলা হলো, এটা হিন্দুস্তান, এটা পাকিস্তান। তার কারণে আমার মা-বাবা একটা দেশ ছেড়ে আরেকটা দেশে এলেন। বোঝালেন যে এটা তোমার দেশ না, এটা তোমার দেশ। প্রথমত, সেখান থেকে কষ্টটা, ক্ষতটা আমি আমার লেখায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি।

আরও পড়ুন
‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বাম থেকে শিরিন হায়াত, আবুল হায়াত, নাতাশা হায়াত ও প্রকাশক তিথি
প্রথম আলো

তারপর আমি যে তিন বছর বয়সে এলাম, এরপর বড় হলাম—সেই বিষয়গুলো লিখতে লিখতে মনে হলো, বাকি জীবনটা লিখে ফেলি। এরপর অনেকবার ফেলে রেখেছি, অবহেলা করেছি। এক পাতা লিখেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি। দশ পাতা লিখেছি। তারপরও পড়ে ছিল বহুদিন। বিপাশা নিয়মিত বলত লেখার ব্যাপারে। আমি বলেছিলাম, “আমার জীবনী কে পড়বে?” তখন বিপাশা বলেছিল, “তুমি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখক। তোমার জীবনী তোমার চেয়ে ভালো কেউ লিখতে পারবে না। আমি চাই, তোমার জীবনীটা লেখা হোক।” এটা মনে হয়েছে, হ্যাঁ, তাই তো, আমার জীবনী আমার চেয়ে ভালো আর কে লিখবে। আমিও তারপর ভাবলাম, লিখি। এরপর তিথি (সুবর্ণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী) যখন বলল, “আমি ছাপাব।” তখন তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করলাম। ভেবেছি আর সময় পাব কি না। এভাবেই লেখা হলো।’

আরও পড়ুন
অভিনয়শিল্পী দুই কন্যা বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াতের সঙ্গে স্ত্রীসহ আবুল হায়াত
প্রথম আলো

‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ লেখার গল্প বলতে বলতে একসময় মঞ্চের পরিবেশ অন্য রকম হয়ে ওঠে। আবুল হায়াত কাছে টেনে নিলেন স্ত্রী শিরিন হায়াতকে। সেই গল্পটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন এভাবে, ‘আজ থেকে তিন বছর আগে চিকিৎসক বললেন, আমার ক্যানসার হয়েছে। আমি জানতে পারলাম, আমি ক্যানসার রোগী। হাসপাতাল থেকে বাসা পর্যন্ত আর কথা বলতে পারিনি।’

স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আবুল হায়াত বললেন, ‘এই মহিলা (শিরিন হায়াত) সারাক্ষণ আমাকে বলতে লাগল, “আরে কী হয়েছে। এটা কি কোনো ব্যাপার নাকি। আমরা আছি। চিকিৎসা করব। যেখানে যা যা লাগে, আমরা করব। তুমি ভালো হয়ে যাবে।” আমার মেয়েরা খবর পেয়েছে। তারাও বিভিন্নভাবে বলেছে, “আব্বু এটা নিয়ে চিন্তা করো না।” যা–ই হোক, আমার তো মন মানে না। রাতে খাবার খেয়েছি কি খাইনি, জানি না। বিছানায় শুয়ে পড়েছি। অন্ধকারে একা কাঁদছি। হঠাৎ টের পেলাম, উনি পাশে এসে শুয়েছেন। আমি তখনো নিঃশব্দে কাঁদছি। হঠাৎ ওনার একটা হাত আমার গায়ে এসে পড়ল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তখন উনি “আল্লাহ তায়ালা এই রোগটা তোমাকে কেন দিল, আমাকে দেখতে পেল না?” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সারাটা জীবন আমার সঙ্গে; আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আনন্দ—সবকিছুতে সে। আজকে আমি এই যে তিনটা বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, শুধু তাঁর কারণে। সে আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা, আমাকে শিখিয়েছে, আই এম আ ফাইটার।’

‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথা বলছেন আবুল হায়াত
প্রথম আলো

আবুল হায়াত যখন এসব বলছিলেন, পুরো মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা। কেউ চোখ মুছছিলেন। হঠাৎ মিলনায়তনের সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। সম্মান প্রদর্শন করলেন আবুল হায়াতকে। করতালি দিলেন। আবুল হায়াত তখন বলছিলেন, ‘আমি শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে চাই। আপনারা দোয়া করবেন। সাথে আমার পরিবার তো রয়েছে।

আরেকজনের কথা না বললেই নয়, চিকিৎসক অসীম কুমার সেনগুপ্ত, তিনি প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কারণে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি।’ আবুল হায়াতের কথা শেষ হয় ঠিকই, তখনো অনেকে চোখের পানি মুছছিলেন, কেউ হাত দিয়ে, কেউ শাড়ির আঁচলে।

আরও পড়ুন
অনুষ্ঠান শেষে ফাহিম হোসেন চৌধুরী গেয়ে শোনান ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গানটি, গাইছেন বিপাশা হায়াত এবং ফারহিন খান জয়িতাও। পাশে স্ত্রী শিরিন হায়াতসহ আবুল হায়াত
প্রথম আলো

‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ নাট্যজন আবুল হায়াতের আত্মজীবনীমূলক এই বই প্রকাশ করেছে সুবর্ণ প্রকাশনী। অভিনয়শিল্পী সংঘ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে গান গেয়ে শোনান ফারহিন খান জয়িতা। তাঁর গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন তাহমিনা সুলতানা মৌ। অনুষ্ঠান শেষে ফাহিম হোসেন চৌধুরী গেয়ে শোনান ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গানটি। মিলনায়তনে উপস্থিত সবাই সমস্বরে গাইলেন গানটি। বের হতে হতে বলছিলেন, অসাধারণ একটি সন্ধ্যা কাটল। বই প্রকাশের এমন একটি অনুষ্ঠান অনন্য একটি স্মৃতিময় সন্ধ্যা হয়ে থাকবে।

‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ, নওয়াজীশ আলী খান, তারিক আনাম খান, সারা যাকের, শাহীন খান, আহসান হাবিব নাসিম, শাহেদ শরীফ খান, মুনিরা ইউসুফ মেমী, পরিচালক আরিফ খান প্রমুখ।

পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন অপি করিম।

আবুল হায়াতের ‘রবি পথ-কর্মময় ৮০’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানেোামন্ত্রিত অতিথিরা
ছবি : আশরাফুল আলম

১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হায়াত। ১৯৪৭ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রামে। মাত্র ১০ বছর বয়সে মঞ্চে ওঠেন অভিনয়ের জন্য। যে অভিনয়ের সঙ্গে এখনো নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন এই অভিনেতা। এরপর ১৯৬৯ সাল থেকে টিভি নাটকে অভিনয় করছেন তিনি।

দীর্ঘ অভিনয়জীবনে নাটকের পাশাপাশি ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘জয়যাত্রা’, ‘গহীনে শব্দ’সহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০০৮ সালে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন।