দিনে দিনে আমাদের মধ্যে ভণ্ডামি বেড়েই চলছে
কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতা ঘটে গেল, তার প্রতিবাদে সোচ্চার সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনও। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন ফেরদৌসী মজুমদার।
যা ঘটছে, তা খুবই ন্যক্কারজনক, দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। আমার খুব মনে হয়, এত অমানুষ পৃথিবীতে আছে? এই ধরনের সহিংসা কিন্তু কখনোই থামেনি। আমাদের মনে হচ্ছিল, এবার বুঝি কিছুই হবে না, সব ভালোভাবে হবে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে গেল। মনে করিয়ে দিল, যেন এটাই নিয়ম। একবার একজন শুরু করে, তারপর চলতেই থাকে। আমরা তো কোনো প্রতিকারও করতে পারছি না। আমরাও আন্দোলন করছি, ওরাও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মনে হয়, আমাদের একটু অন্যভাবে ভাবা দরকার। শাস্তি হোক আর যাই হোক—এমন কিছু করা উচিত, যাতে এসব সহিংসতা থামে। আমরা আন্দোলন করছি, মানববন্ধন করছি, ভাষণ দিচ্ছি, এটা করছি, ওটা করছি—কোনো ফল তো হচ্ছে না। কিছু একটা করতেই হবে। তবে শুধু আমরাই তো পারব না।
সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটুখানি আশা, একটুখানি বিশ্বাস একটু শান্ত হতে না হতেই আবার শুরু হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে কারা যে এমনটা করছে বুঝতে পারছি না। সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে, শত্রুকে চিহ্নিত করতে না পারা। আমার পাশেই কিন্তু আমার শত্রু, কিন্তু চিনতে পারছি না—এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
শত্রু চিহ্নিত করতে পারলে কিন্তু এতটা সমস্যা হয় না। দুঃখজনক, তাদের চিনতে পারছি না। দেখা গেছে, শত্রুর কথায় মিষ্টি ঝরছে, আমার জন্য এটা-ওটা করছে, প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, পেছনে অন্য কোনো পরিকল্পনা করছে। আমার মনে হয়, দিনে দিনে আমাদের মধ্যে ভণ্ডামি বেড়েই চলছে। মানুষ তো মনে হচ্ছে পশু হয়ে গেছে, তা না হলে এই ধরনের মনোবৃত্তি হয় কী করে।
এ ধরনের সহিংসতার দমন শুধু তো আইন দিয়ে হবে না। মানুষের তো মনুষ্য চরিত্র থাকতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষা বাড়াতে হবে। চিন্তা, মনন ও বোধ বাড়াতে হবে। আমার বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কিন্তু কোনো দিন দেখিনি বা শুনিনি—ওরা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান। সবার ওপরে মানুষ সত্য, এটাই সব সময় বোঝাতে চেয়েছেন। আমাদের বাসার পাশেই একটি হিন্দু পরিবার ছিল। তাদের বাসায় শীতলাপূজা হতো। আমরা ওখানে যেতাম। বাবা বলতেন, ওরা যেহেতু চায়, যাও তোমরা। কোনো দিন তো আমাদের মাথার ভেতরে ঢোকানো হয়নি, ওরা হিন্দু। সম্প্রীতির বাংলাদেশ তখন ছিল, এখন আমরা অনেক দূরে সরে গেছি, শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে জানি না। শান্তির জন্য সবাইকে ভালো হওয়ার চর্চা করতে হবে। মানুষ মানুষের জন্য, এটা অন্তরে লালন করতে হবে।