‘এই সময়ে তোর থাকা দরকার ছিল রে’
‘৮ বছর হয়ে গেছে, তোর কোনো মেসেজ নেই, বকাঝকা নেই, সাক্ষাৎ হয় না, ঝগড়া হয় না, নতুন নতুন গল্প নিয়ে আলোচনা হয় না। কিন্তু তুই আছিস আমাদের মনে, আমাদের কথাবার্তায় তুই চির বর্তমান। এই সময়ে তোর থাকা খুব দরকার ছিল রে। ভালো থাকিস ঋতু।’
ইনস্টাগ্রামে এভাবে বন্ধু–সহকর্মী ঋতুপর্ণ ঘোষকে স্মরণ করেন চিত্রনায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। নন্দিত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষের আজ নবম প্রয়াণ দিবস। এই দিনে তাঁকে স্মরণ করে অনলাইনে স্মৃতিচারণা করছেন তাঁর শিল্পস্বজন ও অনুরাগীরা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে অনলাইনে আয়োজন করা হয়েছে তাঁর স্মরণানুষ্ঠানের। এ ছাড়া এই তারকা পুরোনো ছবি দিয়ে স্মৃতিকথায় স্মরণ করছেন গুণী এই নির্মাতাকে।
প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমাণ করেছিলেন, বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি প্রসেনজিৎ অন্য ধারার ছবিতেও অভিনয় করতে পারেন। ২০১৩ সালের ৩০ মে চলে গেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। গত ৮ বছর ঋতুপর্ণ আর কোনো ‘ডাক’ পাঠাননি প্রসেনজিৎকে।
সে কথা মনে করিয়ে পরিচালকের প্রয়াণ দিবসে নতুন করে সেই শূন্যতা আরও এক বার অনুভব করলেন প্রসেনজিৎ। প্রসেনজিতের এই বক্তব্যকে ইতিমধ্যে সমর্থন জানিয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি মানুষ।
অভিনয়ের সূত্র ধরেই একটা সময় পরিচালক ঋতুপর্ণ অভিনেতা প্রসেনজিতের জীবনের ‘ধ্রুবতারা’ হয়ে উঠেছিলেন। প্রয়োজনে প্রসেনজিতকে ঋতুপর্ণ শাসন করেছেন। আবার নিজের হাতে চন্দন পরিয়ে সাজিয়েও দিয়েছিলেন। প্রসেনজিতের আক্ষেপ, মহামারিতে ছবির দুনিয়ায় যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন ঋতুপর্ণের মতো পরিচালকের থাকা খুব দরকার ছিল। এই অভিনেতার বিশ্বাস, ঋতুপর্ণ দুর্দিনেও নতুন পথের সন্ধান হয়তো দিতে পারতেন। তাঁর কাজ দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারতেন চলচ্চিত্র জগৎকে।
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার অভিনয়ের খোলস ভাঙা প্রসঙ্গে প্রসেনজিৎ বলেছিলেন, ‘আমার মধ্যে যে একজন অভিনেতা আছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল ঋতু। গৎবাঁধা নাচ-গান আর মারপিটের বাইরেও যে আমি অন্য ধাঁচের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি, সেটা তো আমি নিজেই জানতাম না। প্রত্যেক অভিনেতাই যেন একজন পরিচালকের খোঁজে থাকেন, যিনি তাঁকে ভেঙেচুরে গড়ে ওঠার সাহস দেবেন, দিকনির্দেশনা ও উৎসাহ দেবেন। আমার জীবনে ঋতু ছিল সেই পরিচালক।’
শুধু প্রসেনজিৎ নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই পরিচালককে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গৌরব চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘২০১৩ সালের আজকের দিনেই বিদায় নিয়েছিলেন কালজয়ী ঋতুপর্ণ ঘোষ, এ রকম মানুষেরা আসেন যুগে যুগে কালে কালে...আসেন কেবল প্রাণভরে সৃষ্টি করতে...কিন্তু মানুষটা অকালেই চলে গেলেন, রেখে গেলেন কিছু সৃষ্টি...।’
জয়া আহসান একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘তাঁর সাহস ছিল চলচ্চিত্রে, সাহস ছিল জীবনে—উন্মোচনের, সীমানা পেরোনোর।’
আশনা হাবিব ভাবনা লিখেছেন, ‘যেই অতীতে তুমি আছে সেই অতীতেই নৌকাডুবি/ হৃদমাঝারে আজও দেখো/ যত্নে রাখা তোমার ছবি।’
ঋতুপর্ণ ঘোষের আবির্ভাব টালিগঞ্জের একটা বিশেষ সময়ে, যখন বাঙালি দর্শক প্রেক্ষাগৃহের প্রতি আগ্রহ প্রায় হারাতে বসেছিলেন। তারকা–নির্ভর হালকা সিনেমা ও বলিউডের ছবির প্রভাব তখন তুঙ্গে। এ সময় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল সিনেমার ধারাবাহিকতায় ভালো কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক কুমার ঘটকের যোগ্য উত্তরসূরি তিনি।
এদিকে ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনাদর্শ এবং কর্মকাণ্ডকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কলকাতার এসপিসি ক্রাফ্ট (কলকাতার প্রথম ইন্টারডিসিপ্লিনারি আর্টস কালেকটিভ) আজ রোববার রাত ৯টায় একটি অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হবে এসপিসি ক্রাফ্টের নিজস্ব ফেসবুক পেজ থেকে। ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখার কিছু অংশ, তাঁর সিনেমার কিছু গান এবং মূলত স্মৃতিচারণার কথনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হবে ‘চিরন্তন ঋতু’ অনুষ্ঠানে। অভিনেতা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, সুরকার ও সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র, অভিনেতা সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়, কণ্ঠশিল্পী শুভমিতা মুখোপাধ্যায় এবং গায়ক রূপঙ্কর বাগচী পরিচালক ঋতুপর্ণের সঙ্গে তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন এই আলোচনায়।
১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’। দ্বিতীয় ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। এই ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র শাখায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর একে একে ‘শুভ মহরত’, ‘রেইনকোট’, ‘অন্তরমহল’, ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’, ‘খেলা’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘আবহমান’, ‘নৌকাডুবি’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘জীবনস্মৃতি’ ছবিগুলো পরিচালনার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রভাবশালী নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ছবিগুলো ঋতুপর্ণ ঘোষকে এনে দেয় ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তা ছাড়া বার্লিন, লোকার্নো, শিকাগো, বুসান, বোম্বের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন এই নির্মাতা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ কর্মজীবন শুরু করেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস এবং পাঁচ বছর ধরে অগ্ন্যাশয়ের রোগে ভুগেছেন। অনিদ্রায় ভুগেছেন মারাত্মকভাবে। চিকিৎসা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু হয়।