আভিজাত্যের প্রতীক ছিলেন তিনি
‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো ত? যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বল তো?’ এই গান শুনলে সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি দুই চাকার যান। আর সেই যানে চড়ে অনন্ত পথ পাড়ি দেওয়ার বাসনা দুজনের। যার মধ্যে একজন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ছেলে–বাবা–দাদা—প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গান শোনেনি এবং এই গানে যাঁরা ঠোঁট মিলিয়েছেন, সেই উত্তম–সুচিত্রাকে চেনেন না, এমন লোক পাওয়া ভার।
বাংলাদেশের পাবনার করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের সংসারে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল যোগ হলো নতুন মেয়ে সদস্য। মেয়ের নাম রাখা হলো কৃষ্ণা। কৃষ্ণার পিতামহ জগবন্ধু দাশগুপ্ত সাধ করে আরেকটি নাম রাখলেন রমা। কিন্তু কে জানত পাবনায় বেড়ে ওঠা সেই রমা দাশগুপ্ত একদিন এই নামকে ছাড়িয়ে সুচিত্রা সেন নামে এপার–ওপার উভয় বাংলা দাপিয়ে বেড়াবেন। নিজের প্রতিভা দিয়ে জয় করে নেবেন সবার মন। ১৯৪৭ সালে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেও নিজের প্রতিভা ছড়িয়ে দিয়েছেন এপারেও।
এই মহানায়িকার অভিনয়ের শুরুটা অত্যন্ত নাটকীয়। অভিনয়জগতের শুরু ‘নটীর পূজা’ নাটকে অভিনয় করে। সেখানে সবাইকে মুগ্ধ করেন অভিনয় দিয়ে। স্বামী ও শ্বশুরের উৎসাহে আসেন সিনেমায়। তাঁর অভিনিত প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ মুক্তিই পায়নি। কেননা কিছুদিন কাজ করার পরে অর্থাভাবে শুটিং বন্ধ হয়ে যায় ছবিটির। এরপর ‘সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমা তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। এই সিনেমার পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতীশ রায় তাঁর নাম পাল্টে দিলেন সুচিত্রা। সিনেমার রুপালি পর্দায় নবজন্ম ঘটল সুচিত্রার।
উত্তমকুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। ছবিটি বক্স অফিসে অসম্ভব সাফল্য লাভ করে। আর এই ছবির মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় উত্তম–সুচিত্রা জুটির। এরপর থেকে দশকের পর দশক পর্দায় এই জুটির প্রেমে মজেছিলেন দর্শক। সেকালের যুবতীদের কাছে সুচিত্রার নিজস্ব স্টাইল যেন ক্রমেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিল। তাঁর শাড়ি পরা বা চুল বাঁধার ধরন জনপ্রিয় ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি সমাজে। আভিজাত্য ও ফ্যাশন–সচেতনতার প্রতীক ছিলেন তিনি। উত্তম–সুচিত্রা জুটি প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন।
সুচিত্রার বাংলা সিনেমায় অভিষেক নাটকীয় হলেও হিন্দি সিনেমার অভিষেক ছিল সাফল্যে ভরা। বলিউডে প্রথম ছবি ‘দেবদাস’। এই ছবিতে পার্বতী চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান সুচিত্রা সেন। তবে প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ভারত সরকার ১৯৭২ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মাননা দেয়।
অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘চৌধুরানী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ব্যস্ততার জন্য সময় দিতে না পারায় কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন সুচিত্রা সেন। পরে চলচ্চিত্রটি নির্মাণই করেননি সত্যজিৎ। সুচিত্রা সেন অভিনীত বাংলা সিনেমার সংখ্যা ৫২, পাশাপাশি ৭টি হিন্দি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।