আমাকে পারলে মরণচাঁদের দই খাওয়াস...
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের প্রয়াণদিবস আজ। ২০১৪ সালের এই দিনে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি, যাঁর অনবদ্য অভিনয় ও অপরূপ সৌন্দর্য আজও দাগ কেটে আছে কোটি দর্শকের হৃদয়ে; অভিনয়গুণে যিনি হয়ে উঠেছিলেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে মহানায়িকা। তাঁর সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম আলোতে লিখেছিলেন চিত্রনায়ক আলমগীর। সুচিত্রার প্রয়াণদিবসে তাঁকে স্মরণ করে সেই লেখা আবার প্রকাশ করা হলো।
আমার দেখা উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম ছবি ‘হারানো সুর’। প্রথম যখন পুরান ঢাকার একটি প্রেক্ষাগৃহে (নাম মনে আসছে না) গিয়ে ছবিটি দেখি, তখন আমার বালক বয়স। পঁয়ষট্টি সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কলকাতার ছবি প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এ জুটির অনেক ছবিই আমি দেখেছি। দুজনারই ভীষণ ভক্ত ছিলাম আমি। অনেক বছর পর যখন ভিডিও ক্যাসেটের যুগ (আশির দশক) আসে, তখন এ জুটির প্রায় সব ছবিই দেখে ফেলি। এ জুটির সর্বশেষ ছবিটি দেখি লন্ডনে, সেটি ছিল ‘সপ্তপদী’।
সেই বালক বয়স থেকেই মনে একটা ইচ্ছা—যদি একবার দুজনকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হতো। উত্তমকুমারকে দেখার সুযোগ না হলেও হয়েছে সুচিত্রাদর্শন। তা-ও একবার নয়, তিন-তিনবার—এমন এক সময়ে, যখন তিনি চলে গেছেন একেবারে আড়ালে। যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তাঁর মেয়ে, দুই নাতনি ছাড়া আর কেউ তাঁর দেখা পাননি।
আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি ১৯৭২ সাল থেকে। এরপর একটা সময় এল, যখন এ দেশে আমার অভিনীত অসংখ্য ছবিই ব্যবসাসফল এবং প্রশংসিত হয়েছে। সেই রকম একটি ছবি ‘সত্য মিথ্যা’ । পরিচালক এ জে মিন্টু। এ দেশে ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ায় ১৯৮৯ সালে কলকাতায় ছবিটির রিমেক করার চিন্তা করলেন ওখানকার প্রযোজক বিজয় খেমকা। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য ওই সময় আমি কলকাতায় যাই। তখন হঠাৎ সুপ্ত ইচ্ছার কথা মনে পড়ল। কিন্তু যাঁকেই আমার ইচ্ছার কথা বলি, তিনিই বলেন, এটা অসম্ভব। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা।
যেকোনো উপায়ে হোক, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় তাঁকে বললাম, ‘সুচিত্রা সেনকে একনজর দেখতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।’ তিনি বললেন, ‘না রে, হবে না।’ এরপর ধরলাম সুপ্রিয়া দেবীকে। তাঁর সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল। তিনি ঢাকায় আমার বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। আমার বাড়ির ড্রয়িংরুমে ঢুকে তিনি দেখেছিলেন, উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর একটি বিশাল ছবি দেয়ালে টাঙানো। সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠতা। তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘দিদি, তোমার সাথে দেখা করতে চাই।’ বললেন, ‘চলে আয়।’ গেলাম। তাঁর বাড়িতে অনেক আড্ডা হলো। নানা কথার ফাঁকে একসময় বলে ফেললাম, ‘মিসেস সেনের দেখা পাওয়া কি সম্ভব?’ তিনি তখন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘কলকাতায় তুই যেকোনো জিনিস চাইবি, আমি ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু এটা একদমই অসম্ভব।’
এরপর গেলাম অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের কাছে। তিনিও বললেন, ‘এ অসম্ভব।’ আমার এ রকম পাগলামো দেখে একজন প্রযোজক (নাম মনে পড়ছে না) আমাকে রত্না দেবীর (একজন মহিলা প্রযোজক) খোঁজ দিলেন, যিনি উত্তম ও সুচিত্রা—দুজনকে নিয়েই ছবি বানিয়েছেন। বললেন, রত্না দেবী হয়তো কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আমি বেহালায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি বাংলাদেশের ছবির খবর রাখেন। আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। অনেক কথার পর বললাম ইচ্ছার কথা। তাঁর মুখেও একই কথা। বললেন, ‘এটা এখন আর সম্ভব না।’ একটু দমে গেলাম। কিন্তু আশা ছাড়লাম না। তখন আমার কলকাতার এক প্রবীণ বন্ধু বারীন ব্যানার্জি আমাকে বললেন, ‘তুমি এত কষ্ট করছ কেন? তুমি তো একজন শিল্পী। সোজা মিসেস সেনের বাড়ি চলে যাও। নিজের ভিজিটিং কার্ডে কিছু লিখে পাঠিয়ে দাও। কাজ হলেও হতে পারে।’
আমি বললাম, ‘আমি তো বাড়ি চিনি না।’ তিনি বললেন, ‘আমি চিনি। তোমাকে আমি নিয়ে যাব।’ পরদিন তাঁর গাড়িতে চলে গেলাম বালিগঞ্জের সাকুর্লার রোডে; সুচিত্রা সেনের বাড়িতে। তখন ওই সড়কের নাম ছিল সম্ভবত ‘প্রমতেষ বড়ুয়া লেন’। বারীনদা আমাকে গেটের সামনে নামিয়ে বললেন, ‘আমি গাড়িতেই বসি। তুমি যাও।’
ধীর পায়ে সুচিত্রা সেনের বাড়ির গেটে গেলাম। ভিজিটিং কার্ড বের করে ভাবলাম—কী লেখা যায়। অনেক ভেবে কার্ডের পেছনে লিখলাম, ‘দিদি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তোমার দর্শন...।’ এতটুকু লিখে কলম থামালাম। এরপর কী লেখা উচিত, দর্শনপ্রার্থী নাকি অন্য কিছু। শেষে লিখলাম, ‘দর্শন প্রার্থনীয়।’ দারোয়ানের হাতে কার্ডটা দিয়ে বললাম দিদিকে পৌঁছে দিতে। ভেতরের বাড়িটি অনেক দূরে। সামনে বিশাল লন। দারোয়ান কার্ড নিয়ে চলে গেলেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ফিরলেন প্রায় ৩০ মিনিট পর। হাতে এক টুকরা কাগজ। আমার হাতে সেই কাগজ দিয়ে হিন্দিতে যা বললেন, তার বাংলা হলো, ‘দিদি আপনাকে কাল সকাল ১০টায় ফোন করতে বলেছেন।
এই কাগজে ফোন নম্বর দেওয়া আছে।’ আমি তখন বুঝে গেছি, কাজ হয়ে গেছে। রাতে হোটেলে ফিরে আমার আর ঘুম হয় না। কখন সকাল হবে। কখন ১০টা বাজবে। কখন ফোন করব। সকালে উঠে চিরকুটে লেখা নম্বরে ঠিক ১০টায় ফোন করলাম। ওপ্রান্তে একজন নারীকণ্ঠ—‘হ্যালো’। এপ্রান্তে আমি। ‘জি, আমি দিদির সাথে কথা বলব।’ ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘তুমি আলমগীর বলছ?’ বললাম, ‘জি।’
ফোনে শোনা গেল, ‘আমি তোমার দিদি বলছি।’ সেই মিষ্টি কণ্ঠ শুনে আমার মুখে আর কথা বের হয় না। তারপরও পাঁচ-ছয় মিনিট কথা হলো। তবু সাহস পাই না। শেষ পর্যন্ত বলে ফেললাম, ‘দিদি, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।’ তিনি নানা ব্যস্ততা দেখালেন, বললেন, ‘এবার সময় হবে না। পরেরবার এসো।’ আমিও নাছোড়। বললাম, ‘দিদি, তুমি কত দিন ব্যস্ত—১০ দিন, ১৫ দিন, ২০ দিন? প্রয়োজনে আমি তত দিন কলকাতায় থাকব। তবু একবার দেখা করতে চাই।’ আমার এ কথা শুনে মনে হলো, বোধ হয় দিদি একটু ভাঙলেন। তিনি একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, ‘আজ তো থার্টি ফার্স্ট নাইট। নিশ্চয়ই পার্টিতে যাবে?’ বললাম, ‘জি যাব।’ বললেন, ‘পার্টিতে যাওয়ার আগে ঠিক ছয়টায় আমার বাড়ি চলে এসো। আমি তোমাকে ১৫ মিনিট সময় দেব।’ তিনটি শর্তও জুড়ে দিলেন। অন্য কাউকে সঙ্গে আনা যাবে না। কোনো ক্যামেরা অ্যালাউড না। কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না।
আমি সব শর্ত মানতে রাজি। তাঁর সঙ্গে দেখা হবে, সেটাই ছিল আসল। কলকাতার সেই সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আব্বাস (পরবর্তী সময়ে ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ ছবির প্রযোজক)। ও আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য গোঁ ধরল। বলল, ‘বন্ধু আমাকে নিয়ে যাও।’ বললাম, ‘শুনলে না, বলেছেন কাউকে সঙ্গে নেওয়া যাবে না।’
এবারও বারীনদা আমাকে তাঁর গাড়িতে করে নামিয়ে দিলেন। আমি সুচিত্রা সেনের বাড়িতে ছয়টা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে গেলাম। গেটে আগে থেকেই বলা ছিল। বিশাল জমিদারবাড়ি। দারোয়ান আমাকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে গেলেন। দোতলায় উঠতেই দেখলাম, বিশাল বারান্দা। লম্বায় প্রায় ৩০ ফুট, আর পাশে ১২ ফুট। সেই বারান্দায় খণ্ড খণ্ড করে সোফা বসানো। আমাকে একটা সোফায় বসিয়ে সে চলে গেল। উল্টো দিক করে বসে আছি। মিনিট দু-তিনেকের অপেক্ষা। সে অপেক্ষায় ছিল ভয়, উত্তেজনা। একটু পর কানে জুতার হিলের শব্দ। ঘুরে তাকাতেই দেখি হালকা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা একজন ভদ্রমহিলা হেঁটে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গেই চিনে ফেললাম। তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম। তিনি তখন হয়তো ১০ ফুট এসেছেন। বাকি ২০ ফুট তিনি দুই হাত জোর করে নমস্কার ভঙ্গিতে আমার দিকে এলেন। কাছে আসতেই আমি তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি আমাকে ধরে ফেললেন। আমার তখন হাঁটু কাঁপছে। কারণ, সুচিত্রা সেনের হাতের স্পর্শ আমার গায়ে লেগেছে। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে প্রণাম করলে কেন।’ বললাম, ‘তোমার মতো একজন মহান শিল্পীর পায়ের ধুলা নেব না! তা কি হয়?’ তিনি তখন বললেন, ‘একজন শিল্পী হিসেবে তুমি যদি আমাকে প্রণাম করতে পারো, তবে তুমিও তো শিল্পী। তোমাকেও আমার প্রণাম করা উচিত। কারণ, শিল্পীর কোনো বড়-ছোট নেই। সব শিল্পী সমান।’ আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, ‘আমি ভাই হিসেবে দিদিকে প্রণাম করেছি।’ শুনে তিনি বললেন, ‘তাহলে ঠিক আছে।’ জীবনে প্রথম দুই চোখ ভরে দেখা। তাঁর সম্পর্কে আর কী বলব! এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা এ জীবনে দেখিনি। ছবিতে তিনি যেভাবে কথা বলেন, বাস্তবেও সেই রকম। আর হাসিতে লেগে আছে অন্য রকম সৌন্দর্য আর মায়া।
কলকাতায় একটি ছবিতে কাজ করতে এসেছি, তাঁকে জানালাম। কথা বলার পর অবাক হলাম যে তিনি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বেশ খোঁজ রাখেন। দিদি প্রথমেই জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের অভিনেতা আনোয়ার হোসেন কেমন আছেন?’ এরপর বললেন রাজ্জাক-কবরীর কথা। এরপর বললেন, ‘শুনেছি, তুমি আর শাবানা বেশ ভালো কাজ করছ।’
অনেক কথার মধ্যে বললাম। ‘দিদি এই একাকিত্ব বেছে নিলেন কেন?’ তিনি একটু হাসলেন। বললেন, ‘কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়।’ তারপর বললেন, ‘তুমি একটু বসো। তোমাকে চা দিই?’ বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, চা খাব।’ আসলে আমার তো চায়ের নেশা নয়, দিদির সঙ্গে আরও কিছু সময় কাটাতে পারব, সেটাই ইচ্ছা। তিনি কাউকে ডাকলেন না। নিজেই চলে গেলেন। একটু পর নিজেই ট্রে হাতে ফিরলেন। ট্রেতে কুকিজ বিস্কুট, তিনটি নারকেলের নাড়ু, আর এক কাপ চা। আমি আবার নারকেল দিয়ে বানানো কোনো খাবার খাই না। তাই বিস্কুট আর চা খাচ্ছিলাম। দিদি তখন বললেন, ‘আলমগীর, তুমি নাড়ু খাচ্ছ না কেন? ওটা আমি নিজ হাতে বানিয়েছি।’ আমি দেরি না করে তিনটা নাড়ুই খেয়ে ফেললাম। খেতে খেতে জিজ্ঞেস কললাম, ‘অভিনয় ছেড়ে দিলে কেন?’ উত্তরে সুচিত্রা সেন শুধু বললেন, ‘ডিরেক্টর কোথায়?’ আর কিছুই বললেন না।
কথায় কথায় বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন। তিনি বেশ ধূমপায়ী। দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে আমার সামনেই ধরালেন। তারপর আয়েশি টান দিয়ে বললেন, ‘লুকিয়ে যেতে পারব? সবাই কি চিনে ফেলবে?’ বললাম, ‘কেউ তোমাকে চিনবে না, এ নিশ্চয়তা দেওয়া মুশকিল।’ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘যখন যাব, তখন ঘোমটা দিয়ে মুখ লুকিয়ে যাব। তুই (একপর্যায়ে ‘তুই’ সম্বোধন) আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তোর বাড়িতে নিয়ে লুকিয়ে রাখবি।’
এরপর বললেন, ‘আমি একটু যশোর যাব, তারপর পাবনা।’ বললাম, ‘তুমি তো পাবনার মেয়ে। যশোর যাবে কেন?’ বললেন, ‘আমি যশোরের মেয়ে। কিন্তু আমার জন্ম, পড়াশোনা পাবনায়। সেখান থেকে সোজা কলকাতা। কখনো যশোর যাওয়া হয়নি। সেখানে আমাদের পৈতৃক ভিটেবাড়ি ছিল, একবার দেখার খুব ইচ্ছে।’ এভাবে ১৫ মিনিট নয়, কখন যে এক ঘণ্টা কেটে গেল, টের পেলাম না।
যখন উঠে চলে আসব, তখন মনে হলো, মুখটা তো আর কোনো দিন দেখব না। তাই ভাবলাম, দেখি আরেকবার দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে কি না। বুদ্ধি করে বললাম, ‘দিদি, আমি তো আগামী মাসে কলকাতায় শুটিং করতে আসব, তোমার জন্য কি বাংলাদেশ থেকে কিছু আনব?’ তিনি বললেন, ‘না রে, কিছু লাগবে না।’ আমি চুপচাপ আরেকবার তাঁর মুখটা দেখলাম। তারপর সিঁড়ি দিয়ে যখন নেমে আসছি, তখন পেছন থেকে তিনি ‘শোন’ বলে ডাকলেন। আমি ফিরে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, ‘ছোট ভাই যখন বানিয়েছি, তখন ছোট ভাইয়ের কাছে কিছু চাওয়া যায়। আমাকে পারলে মরণচাঁদের দই খাওয়াস।’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘অবশ্যই।’ বিদায় নিয়ে তারপর চলে এলাম।
পরের মাসে শুটিং করতে কলকাতায় যাওয়ার সময় দিদির জন্য মরণচাঁদের দই আর এক কার্টন সিগারেট (বারীনদা সিগারেট নেওয়ার বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন) নিয়ে গেলাম। তারপর ফোনে দিদিকে দইয়ের কথা বললাম। শুনে দিদি বললেন, ‘তুমি আগে দইটা ফ্রিজে রাখো। তারপর সন্ধ্যায় নিয়ে এসো। আমি বাড়িতেই আছি।’ কিন্তু সেদিন কোনো টাইম বেঁধে দেননি। সেদিনের দেখাটা ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ। কারণ, তাঁর ভীষণ তাড়া ছিল। প্রস্তুতি দেখেই বুঝলাম, বাইরে যাবেন। তাই বেশিক্ষণ বসা হলো না। কিন্তু সেই ব্যস্ততার মাঝেও চা খাওয়াতে ভুললেন না।
এরপর তৃতীয় দফায়ও শুটিংয়ে যাওয়ার সময় দিদির জন্য ঢাকা থেকে দই আর সিগারেট নিয়ে গেলাম। গিয়ে ফোন করলাম। দিদি ফোনে বললেন, ‘দইটা বেশ ভালো। সন্ধ্যায় এসো।’ দই নিয়ে সন্ধ্যায় দিদির বাড়ি হাজির হই। সেদিন বেশ লম্বা সময় পাওয়া গেল। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন। জানালেন, পত্রিকায় আমাদের ‘সত্য মিথ্যা’ ছবির শুটিংয়ের খবর তিনি পড়েছেন। সন্ধ্যা রায়ও কাজ করছেন, সেটাও বললেন।
এরপর নিয়মে পরিণত হলো বিষয়টি। চতুর্থবারও দই নিয়ে কলকাতায় গেলাম। দিদিকে ফোন দিলাম। বললাম দইয়ের কথা। তাঁর বেশ তাড়া ছিল। তিনি ফোনে জানালেন, এবার দেখা হবে না। কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন, দইটা বাড়িতে যেন পৌঁছে দিই। আমিও তা-ই করি।
শুটিংয়ের ব্যস্ততার কারণে সেবার আর যোগাযোগ হয়নি। শুটিং শেষে দেশে ফেরার সময় মনে হলো, দিদিকে একটা ফোন দিই। বললাম, ‘দিদি, আগামী মাসে আবার আসব। তোমার জন্য কি দই আনব?’ তিনি ফোনে বললেন, ‘না ভাই, দইটা খেলে আমার একটু অসুবিধা হয়। তুমি কষ্ট করে আর এনো না।’ দিদির সঙ্গে এরপর এক-দুবার ফোনে কথা হয়েছিল। কিন্তু তারপর কোনো দিন আর দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি।