‘অর্ধাঙ্গিনী’ একবারের দেখায় সাধ মিটবে না
কোন জায়গা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কাকে দিয়ে শুরু করব, সেটাও বুঝতে পারছি না। একটা ঘোরের ভেতর আছি।
শুরুতেই বলে রাখি, সিনেমাটা শেষ করে বের হয়ে আমরা তিনজনই বলেছি, ‘অর্ধাঙ্গিনী’ আবার দেখতে হবে। একবারের দেখায় সাধ মিটবে না।
কৌশিক গাঙ্গুলি নির্মিত কোনো সিনেমাই আমার অদেখা নয়। অসম্ভব পছন্দের নির্মাতা; তাঁর গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা এবং সুনিপুণ নির্মাণশৈলী, সেই সঙ্গে এই সিনেমার মূল দুই কান্ডারি চূর্ণী গাঙ্গুলি ও জয়া আহসানের তুখোড় অভিনয় ন্যানোসেকেন্ডের জন্যও মনোযোগ অন্য কোথাও যেতে দেয়নি। পুরোটা সময়ই ছিল টান টান উত্তেজনা। আর এত সিরিয়াস মুহূর্ত, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আমার। এর মধ্যেও যে দর্শককে একটু আনন্দ দেওয়া যায় ছোট্ট একটা সংলাপের মাধ্যমে, সেটা এই সিনেমা না দেখলে বোঝা যাবে না।
পুরো হলের দৃশ্যও ছিল একই—আমরা কাঁদছি, তার মধ্যে পর্দার ‘বিহু’ বা ‘সুকান্ত’র কথায় হাসছি। সিনেমাটিতে বারবার অতীত এবং বর্তমানের গল্প বলা হচ্ছিল। অথচ একমুহূর্তের জন্যও ছন্দপতন হয়নি। কিন্তু শুরু থেকেই ছিল চরম উত্তেজনা। অতীত ও বর্তমানের দৃশ্যের যোগসূত্রে খুব সূক্ষ্মভাবে কৌশিক গাঙ্গুলি এমনভাবে সুতা বুনেছেন যে দর্শকের বাহ্বা না দিয়ে উপায় নেই।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আমি অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান ও ব্যক্তি জয়া আপুর অন্ধভক্ত। কলকাতায় এসেছি, তাঁর সিনেমা মুক্তি পেয়েছে আর সেই সিনেমা দেখব না, সেটা হতেই পারে না। আমরা তিন বাংলাদেশি (মৌসুমী মৌ, বিশ্বজিৎ বাপ্পী ও কামরুজ্জামান আসিফ) গিয়েছি সিনেমাটি দেখতে। কাকতালীয়ভাবে তিনজনই বৃহত্তর ফরিদপুরের। আর আমাদের জয়া আহসানের বাড়িও বৃহত্তর ফরিদপুরে। মজার বিষয় হলো, এই সিনেমায় মেঘলা মুস্তফিকে (জয়া আহসান) যখন একটা দৃশ্যে জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশে বাড়ি কোন অঞ্চলে? তিনি বলেন, ফরিদপুরে। তখন আমাদের তিনজনের আনন্দ দেখে কে! আমাদের ফরিদপুরের কমন ডায়ালগ ‘অনেক খিদা লাগছে’; এটা শুনতেও খুব ভালো লাগছিল।
যা–ই হোক, সিনেমাটি দেখার আগে অনেক রিভিউ দেখেছি, নিউজ পড়েছি। তার মধ্যে শম্পালী মৌলিকের লেখা থেকে একটু কোট করতে চাই, ‘একজন পুরুষের দুই অর্ধ হয়ে তারা অতীত ও বর্তমানের জীবন্ত ছবি।’
চূর্ণী গাঙ্গুলি ও জয়া আহসান হলেন ‘অর্ধাঙ্গিনী’র প্রাণ! কৌশিক গাঙ্গুলি শুভ্রা চ্যাটার্জি ও মেঘনা মুস্তফি চরিত্রের জন্য সেরা এবং যথার্থ দুজনকেই নির্বাচন করেছেন।
জয়া আহসানকে নিয়ে পেছনের সারিতে বসা কলকাতার কিছু দর্শক বলছিলেন, এত দারুণ অভিনয় করেন জয়া! আমরা মেঘনাকে দেখেছি; জয়া আহসানকে খুঁজে পাইনি। মেঘনার জন্য কেঁদেছি। তার অসহায়ত্ব, শুভ্রার অপমান সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের পীড়া দিচ্ছিল।
অন্যদিকে চূর্ণী গাঙ্গুলি অনন্য, অসাধারণ! তাঁর সেই সংলাপ ভুলতে পারছি না—‘প্রাক্তন স্ত্রী মহাজনের মতো। সে জানে, সে তার ক্যাপিটালটা কোনো দিনই পাবে না।’ এই কথার ভার ব্যাখ্যা করা যায় না। শুভ্রার জন্য অনেক কেঁদেছি। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুভ্রার জন্য কেঁদেছেন দর্শক।
‘আমি আবার ক্লান্ত পথচারী, এই কাঁটার মুকুট লাগে ভারী/ গেছে জীবন দুদিকে দুজনারই, মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি?’ ছবিতে ইমন চক্রবর্তীর গাওয়া গানটির প্রথম চার লাইনে সিনেমার পুরো গল্পের সারমর্ম আছে। এই দুই অর্ধাঙ্গিনীর ‘প্রাইভেট মিটিং’-এর মুহূর্তটা ছিল অসাধারণ।
সুমন চ্যাটার্জির (কৌশিক সেন) ওপর অনেক রাগ আমার। তার মতো বিশেষ করে আমাদের সমাজের এমন বীর্যবান পুরুষদের শোধরানো উচিত। কৌশিক সেনের মতো এমন শক্তিমান অভিনেতা ও শিক্ষক যে গল্পে থাকবেন, সেটাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করবেন, খুবই স্বাভাবিক।
গল্পের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত। মা, ছোট জেঠু, বড়দা, বড় বউদি, বিহু, সুকান্ত—প্রত্যেকেই। সুকান্ত ও বিহু ছিল এই গল্পের মসলা। আরও অনেক কথা লিখতে ইচ্ছা করছে। গণেশ ঠাকুরের চাবির রিং থেকে হাসপাতালে বিহুর গুল মারার মুহূর্তে মায়ের শাড়ি চেনার বিষয়—এমন আরও খুঁটিনাটি।
তবে কৌশিক গাঙ্গুলির ওপর অনেক অভিমান নিয়ে হল ছেড়েছি। কেন অভিমান করেছি, সেটা জানতে হলে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ দেখতে হবে।
শেষ দৃশ্যের মনস্তত্ত্বটা ছিল ভাবার মতো। লিফটটা বন্ধ হলো; গৌতম বুদ্ধের অর্ধছবি জোড়া লেগে গেল। এরপরের শেষ সময়টুকু অপারেশন থিয়েটারে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পরমুহূর্তে রোগীর যেমন অনুভূতি হয়, আমার তেমন অনুভূতি হচ্ছিল।
সিনেমাটা দেখা শেষে আরেকটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। কোয়েস্ট মলের আইনক্সে ‘অর্ধাঙ্গিনী’র পোস্টার ছিল না। আমরা সেখান থেকে ডায়মন্ড প্লাজায় গিয়ে পোস্টারের সঙ্গে মন ভরে ছবি তুলেছি।
এককথায় দুর্দান্ত একটা সিনেমা দেখে শেষ করলাম। এবার হুট করে কলকাতায় আসা সার্থক।