‘মছলিবাবা’র কথা মনে আছে?
মনু মুখোপাধ্যায় নামটি হয়তো চট করে এ বাংলার দর্শকের মনে পড়বে না। তবে পর্দায় দেখলে তাঁকে চেনা খুব বেশি কঠিন হবে না। তাঁকে দেখলে যেমন ‘মছলিবাবা’র কথা মনে পড়ে, তেমনই মনে ঝিলিক দেয় ‘পাতালঘর’ ছবির সেই ‘অপয়া বৃদ্ধ’ গোবিন্দ বিশ্বাস, যাকে উদ্দেশ করেই সেই গান ‘তুমি কাশী যেতে পারো/ যেতে পারো গয়া/ পাবে না এমন দ্বিতীয় অপয়া।’ কৌতুকপূর্ণ এই গান আর বাকি ছবিতে মনুর দুরন্ত অভিনয় চরিত্রটিকে মনে রাখবে বহুদিন।
অথবা ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির সেই খলচরিত্র। দাঁতে বিড়ি চেপে ছোট শিশুদের উদ্দেশে ছুরি তুলতেও যার হাত কাঁপে না। চোখেমুখে ঝলসে ওঠে নিষ্ঠুরতা। সেই ছবিতে একদম তরুণ মনুকে দেখলে শিশুরা তো বটেই, বড়দেরও বুক কেঁপে উঠতে বাধ্য! আজ গুণী এই অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ১ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন মনু মুখোপাধ্যায়।
প্রকৃত নাম সৌরেন্দ্রনাথ, কিন্তু মনু নামেই পরিচিত তিনি। ১৯৪৬ সালে ভারতী বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন, এরপর মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। সে সময় অল্প বয়সে পাড়ার নাটকের দলে ‘নারী’ চরিত্রে অভিনয় করতেন। ১৯৫৭ সালে বিশ্বরূপায় যোগ দেন প্রম্পটার হিসেবে। ‘ক্ষুধা’ নাটকে ঘটনাচক্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন মনু মুখোপাধ্যায়। এরপর ধীরে ধীরে উত্তরণের গল্প। হাইকোর্টে কেরানির পদে চাকরি করতেন, তবে অভিনয় ছিল তাঁর নেশা। নেশার টানে পেশায় ইতি টেনেছিলেন।
সমালোচকদের মতে, যেকোনো চরিত্রে তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছিল। মনু মুখোপাধ্যায় অভিনীত প্রথম ছবি মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’। সেই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই পরিচালকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন মনু মুখোপাধ্যায়কে। এরপর বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও রোন্যান্ড জোফির সঙ্গে কাজ করেছেন প্রয়াত এই অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়ের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ভণ্ড সাধু ‘মছলিবাবা’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও দর্শকমনে নিজের ছাপ রাখতে বরাবর সফল হয়েছেন মনু মুখোপাধ্যায়। নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ভক্তদের মনে দশকের পর দশক ধরে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। সত্যজিতের ‘অশনিসংকেত’, ‘গণশত্রু’র মতো ছবিতেও অভিনয় করেছেন মনু মুখোপাধ্যায়।
টালিউড চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি মনু মুখোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী অভিনেতাকে সেভাবে ব্যবহার করতে পারেনি—এই অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। ‘নায়ক’ ছবিতে অরিন্দমের চরিত্রে উত্তম কুমার বলেছিলেন, ‘ক্যামেরার সামনে অতি অভিনয় চলে না।’ কথাটা যে কত বড় সত্যি, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ নিঃসন্দেহে মনু মুখোপাধ্যায়। অভিনয় জীবনজুড়েই যেন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নিম্নবিত্ত অসহায় বাঙালির এক প্রতিনিধিকে। আবার একই সঙ্গে খলনায়কের ভূমিকায়ও চমকে দিয়েছেন সহজাত অভিনয়ে।
বয়সের কারণে কিছুটা বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেও মনু কিন্তু কাজ করে গিয়েছেন শীর্ণ শরীরেও। দীর্ঘ সময় অতিথি চরিত্রে কিংবা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের পর ২০০৩ সালে পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরীর ‘পাতালঘর’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন মনু মুখোপাধ্যায়। শেষ দিকে ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবিতে মনু মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় চমকে দিয়েছে দর্শকদের। তিনি অভিনয় করেছেন পরিচালক সায়ন্তন ঘোষালের ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’ ছবিতেও। তখন তাঁর বয়স ৮৮। রুপালি পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দায়ও নিয়মিত অভিনয় করেছেন তিনি। ‘পৌষ ফাগুনের পালা’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ ইত্যাদি ধারাবাহিকে মনু মুখোপাধ্যায়কে দেখছেন বাঙালি দর্শক।
ব্যক্তিগত রসায়নের ভিত্তিতে মানুষ কাজ পান এই ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই মনু মুখোপাধ্যায়ের মতো দুর্দান্ত অভিনেতা খুব বেশি সুযোগ পাননি। এমনই মনে করেন পরিচালক-অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়। তাঁরই ছবি ‘ভটভটি’তে শেষবারের মতো অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত শিল্পী মনু মুখোপাধ্যায়। ২০১৯ সালে শুটিং করেছেন। তারপর ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর মাসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সত্যজিৎ রায়ের ‘মছলিবাবা’। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৯০ বছরের এই অভিনেতা।