শিশুপার্কের সামনে মঞ্চ ছিল, গান ছিল, ছিলেন না ফকির আলমগীর
শিশুপার্কের সামনে নারিকেলবীথি চত্বরে পয়লা বৈশাখে একটা মঞ্চ হয়। শিশুর সারল্য নিয়ে একজন মানুষ মাতিয়ে রাখতেন সেই মঞ্চ। স্বরে–সুরে তিনি কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈশাখকে, গাইতেন গণমানুষের গান। সেই গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরহীন প্রথম বৈশাখ এল। গত বৈশাখেও যে মঞ্চে তিনি গেয়েছেন গান, এই পয়লা বৈশাখেও সেখানে মঞ্চ হয়েছে, গীত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গান। কেবল ছিলেন না তিনি।
আজ বাংলা নতুন বছর ১৪২৯–এর প্রথম দিন। ভোর থেকে সরব ছিল রাজধানীর শিশুপার্কের পাশের সেই মঞ্চ। সেখান থেকে শোনা যায় ‘মানুষের মাঝে বসবাস করি’, ‘মোর সখিনার কপালে টিপ’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গানগুলো। ফকির আলমগীরের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া এ গানগুলো গেয়ে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধা সমর বড়ুয়া, আরিফ রহমান, মিজানুর রহমানরা। ফকির আলমগীরের ভাই শিল্পী ফকির সিরাজ গেয়ে শুনিয়েছেন ‘বাংলার কমরেড বন্ধু’, ‘আজও আছে একতারা আর নকশিকাঁথার মাঠ’ গান দুটি। এসব গান রেখে গত বছরের ২৩ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ফকির আলমগীর।
ফকির আলমগীরদের সংগঠন ঋষিজের আয়োজনে বর্ষবরণের আজকের উৎসব শুরু হয় ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া ছিল স্পন্দন নাচ, অনন্যা, ইকবাল খুরশিদের আবৃত্তি। কেবল স্মৃতি হয়ে ছিলেন সংগঠনের দীর্ঘদিনের সভাপতি ফকির আলমগীর। তাঁর ও সদ্য প্রয়াত আবৃত্তিকার হাসান আরিফের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে এক মিনিট নীরব ছিলেন উপস্থিত সবাই। তারপর সরব হয়েছেন গানে, গেয়েছেন রফিকুল আলম, ফকির শাহাবুদ্দিন, আরিফ রহমান, আবুবকর সিদ্দিকরা। গত বছরও এই মঞ্চে কোন কোন জ্যেষ্ঠ শিল্পী গাইবেন, কোন কোন তরুণ গাইবে, কোন সংগঠন কখন পরিবেশন করবে, সেসব ঠিক করে দিয়েছেন ফকির আলমগীর। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠান করে ফকির আলমগীর এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করতেন প্রতিবছর। তাঁর প্রয়াণের পর সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তাঁর স্ত্রী বেগম সুরাইয়া আলমগীর। আজ সকালে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন। ফকির সিরাজ বলেন, ‘তাঁর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বেগ পেতে হয়েছে। তবু আমরা চেষ্টা করেছি, একটা সফল অনুষ্ঠান করার। সকাল ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা, সাড়ে চার ঘণ্টা চলে এ অনুষ্ঠান।’
দীর্ঘ ৪৫ বছর একজন সংগঠক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাল ধরে ছিলেন। ১৯৮৩ সাল থেকে পয়লা বৈশাখের প্রথম সকালে রাজধানী শাহবাগের নারিকেলবীথি চত্বরে নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করে। নাচ, গানসহ নানা আয়োজনে অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে জমে ওঠে তাঁদের আয়োজন। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা আজও গেয়েছেন সমস্বরে। প্রতিটি মুহূর্তে তারা অনুভব করেছেন ফকির আলমগীরের অভাব। ষাটের দশক থেকে সংগীতচর্চা শুরু করেন তিনি। সেই থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন।
ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন গান দিয়ে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে পুঁজি করে দেশীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধনে তিনি ও সমসাময়িক কয়েকজন শিল্পী শুরু করেছিলেন প্রথম বাংলা পপ ধারার গান। সেই ধরার বিকাশে ফকির আলমগীরের রয়েছে বিশেষ অবদান। তাঁর কণ্ঠে ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ও সখিনা গেছস কি না ভুইলা আমারে’ গানগুলো কখনই ভোলার নয়। তেমনি পয়লা বৈশাখেও ফকির আলমগীরকে মনে করবে বাঙালি।