বিশ্ববাজারে ঢুকছে বাংলাদেশের গান
গান থেকে প্রতিবছর রেমিট্যান্স আসছে ছয় লাখ ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স আনলে কর না কেটে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়। শীর্ষ অর্জনকারীদের এখন সিআইপি কার্ড দেওয়ার কথা ভাবছে কপিরাইট রেজিস্ট্রার।
বাংলাদেশের গানের বাজার কি তবে ‘নাই’ হয়ে যাবে? কয়েক বছর আগেও স্থানীয় অডিও বাজারে এমন প্রশ্ন নিয়মিতই শোনা যেত। রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গিয়েছিল এ শিল্প। কয়েক বছরেই পাল্টে গেছে সেই চিত্র। নাই তো হয়নি, বরং স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের শিল্পীদের গান। আসছে নিয়মিত রেমিট্যান্স। বছরে নিচে ৫ হাজার ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার আয় করে ৫০ জন শিল্পী রেমিট্যান্সে অবদান রাখছেন। পাশাপাশি শীর্ষ ১০টি অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বছরে তিন লাখ ডলার আয় করছে। প্রতি বছর বাড়ছে এর পরিমাণ।
আশি দশকে দেশের অডিও শিল্পে রমরমা বাণিজ্য ছিল। ঢাকার নবাবপুর, পাটুয়াটুলী; চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার ও খুলনার নিউমার্কেটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অডিও শিল্প। এ খাতে বছরে শতকোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হতো। এ শিল্প থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে বিত্তশালী হয়েছেন অনেক শিল্পী। একসময় ক্যাসেটের বাজার থেকে সিডির বাজারে এটি রূপান্তরিত হয়।
মুঠোফোনের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিডির বাজারটি ক্রমে লুপ্ত হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে অডিওর বাজার। নবাবপুর ও পাটুয়াটুলী থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় সাউন্ডটেক, সংগীতা, সারগাম, সিএমভি, অনুপমের মতো বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। বন্ধ হয়ে যায় অডিও সিডির লক্ষাধিক দোকান।
অডিও বাজারের সর্বনাশের কারণ হয়েছিল যে মুঠোফান ও কম্পিউটার, ডিজিটাল বিপ্লবের কল্যাণে সেগুলোই আবার এই শিল্পকে দিয়েছে নতুন জীবন। তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনা। বাংলাদেশে এখন ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সামাজিকমাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি অনেকের কাছে এগুলো অর্থ আয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠছে। গত অক্টোবর মাসে কপিরাইট অফিস ঘোষণা করে, ৯ মাসে প্রয়াত ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চুর গানের রয়্যালটি হিসেবে রেমিট্যান্স জমা হয়েছে পাঁচ হাজার ডলার। তাঁর কপিরাইট নিবন্ধন করা ২৭২টি গানের ডিজিটাল আর্কাইভিং কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর, ইতিমধ্যে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এ রেমিট্যান্স জমা হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাউলশিল্পী আবদুল কুদ্দুস বয়াতি, সুরকার শেখ সাদী খান, প্রিন্স মাহমুদ, ব্যান্ড তারকা জেমস, সংগীতশিল্পী মনির খান, এসডি রুবেল, বাদশা বুলবুল, সেলিম চৌধুরী, শুভ্র দেব, কনা, হাবিব ওয়াহিদ, ইমরানসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী দেশে রেমিট্যান্স আনায় ভূমিকা রাখছেন। এসব শিল্পীর নামে নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা আসছে বলে জানান রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস। শীর্ষ আয় করা ১০ শিল্পীর প্রতে৵কে বছরে ১০ হাজার ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আয় করেন। এর মধ্যে চেনা জনপ্রিয় শিল্পীর পাশাপাশি বেশ কয়েকজন নবীন শিল্পীও আছেন। রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী জানান, ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল একটি সেমিনারে প্রবাসী শিল্পী মামুন স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। দেশের অন্য শিল্পীরা সচেতন হতে থাকেন।
তাঁরা নিজের নামে গান নিবন্ধন করেছেন। এর বাইরে বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও আলাদা করে গানসহ বিভিন্ন বিনোদন কনটেন্ট নিবন্ধন করেছেন। বর্তমানে মোট ১০ হাজার ৮৬টি গান নিবন্ধন করা হয়েছে।
যাঁরা রেমিট্যান্স আনছেন, পরিমাণভেদে তাঁদের সিআইপি (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যাদা দেওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। এ ছাড়া গান থেকে আসা রেমিট্যান্সে কোনো কর কাটা হয় না; বরং ২ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করা হয়। শুধু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকার বেশি হলে সামান্য কর কাটা হয়।
এ ছাড়া অনিবন্ধিত অনেক গান, নাটকসহ বিভিন্ন কনটেন্ট থেকেও আয় আসছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন শিল্পীদের সচেতনতাই নানান মাধ্যম থেকে রেমিট্যান্স এবং রয়্যালটি বাড়ার কারণ। অধিকার আদায়ে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকারেরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন। যেমন ২০১৭ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৫০। পরের বছর রেজিস্ট্রেশন বেড়ে হয় ১ হাজার ৭৯৫টি, ২০১৯ সালে এটি দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০৫টিতে; আর গত বছর এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬২১টিতে। ক্রমে সংখ্যাটি বাড়ছে। শিল্পীদের রেমিট্যান্স অর্জনের বিষয়টিতে সরকারও নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছে।
রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরী জানান, যাঁরা রেমিট্যান্স আনছেন, পরিমাণভেদে তাঁদের সিআইপি (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যাদা দেওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। এ ছাড়া গান থেকে আসা রেমিট্যান্সে কোনো কর কাটা হয় না; বরং ২ শতাংশ প্রণোদনা যোগ করা হয়। শুধু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকার বেশি হলে সামান্য কর কাটা হয়। এর বাইরে শিল্পীদের যেকোনো পরিমাণের অর্থ করমুক্ত। ডিজিটাল দুনিয়ার প্রবেশ করার ফলে বর্তমানে গানে গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও যন্ত্রীর পাশাপাশি নতুন কিছু পেশাজীবীর চাহিদা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এসব ক্ষেত্রে অনেক তরুণ কাজ করছেন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, যথার্থ পরিচর্যা ও উৎসাহ দেওয়া গেলে, সংগীতও হয়ে উঠতে পারে রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস।