বাবাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে চান ছেলে
‘আমার আব্বা আর নেই।’ আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বললেন সামির আহমেদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (৬৩) আর নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ মঙ্গলবার সকালে তিনি রাজধানীর আফতাবনগরে নিজ বাসায় মারা যান। সামির আহমেদ বলেন, ‘আব্বাকে আজই দাফন করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আব্বাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে দাফন করার অনুমতি দিন।’
সামির আহমেদ জানান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। তিনি হৃদ্রোগে ভুগছিলেন। তাঁর হার্টের ধমনিতে আটটা ব্লক ছিল। গত বছর মে মাসে রিং পরানো হয়। ইদানীং তাঁর শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছিল না। সমস্যা হচ্ছিল। গতকাল সোমবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেতে পারেননি। আজ ভোর চারটার দিকে তিনি তাঁর রেকর্ডিস্ট রোজনকে ফোন করে নিজেই অসুস্থতার কথা জানান। এরপর সবাই তাঁর কক্ষে ছুটে যান। অ্যাম্বুলেন্স খবর দেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁকে সকাল সোয়া ছয়টা নাগাদ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তখন চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আসলে তিনি বাসাতেই মারা গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মারা যান।’
গত বছর ১৬ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লিখেছেন, ‘একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে আটটা ব্লক ধরা পড়েছে। এরই মধ্যে কাউকে না জানিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে সিসিইউতে চার দিন ছিলাম। আগামী ১০ দিনের মধ্যে হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘কোনো সরকারি সাহায্য কিংবা শিল্পী, বন্ধুবান্ধবের সাহায্য আমার দরকার নাই। আমি একাই যথেষ্ট। শুধু অপারেশনের আগে ১০ সেকেন্ডের জন্য বুকের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা আর কোরআন শরিফ রাখতে চাই।’ এর পর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংগীতজগতে অবদানের জন্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যখন অংশ নেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। তাঁর সুরে ও সংগীতে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের পাশাপাশি এ প্রজন্মের অনেকে গান গেয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপা, মনির খান, জেমস, বাপ্পা মজুমদার, নোলক, রাজীব, কোনাল, সালমা, বিউটি, সাব্বির, কিশোর প্রমুখ।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে দুবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রথমটি ছিল ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ আর দ্বিতীয়টি ছিল ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি’, ‘ও আমার মন কান্দে’, ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা’, ‘আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘ওই চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘সাগরের মতোই গভীর, আকাশের মতোই অসীম’, ‘প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনা বিধুর’, ‘আমার সুখেরও কলসি ভাইঙ্গা গেছে লাগবে না আর জোড়া’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘কী আমার পরিচয়, ঠিকানা কী জানি না’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন’, ‘আমার হৃদয় একটা আয়না’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না’, ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘এই জগৎ সংসারে তুমি এমনই একজন’, ‘জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে’, ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’, ‘নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে’, ‘ও ডাক্তার, ও ডাক্তার’, ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার’ ও ‘আট আনার জীবন’।