তাঁর অনুপস্থিতি শূন্যতাবোধ তৈরি করে
ফকির আলমগীর যেন ছিলেন একটা ‘জীবন্ত জাদুঘর’ অথবা ‘আর্কাইভ’। সংরক্ষণের নেশা ছিল তাঁর, বিশেষ করে ছবি। বাংলাদেশের এমন কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তি নেই, যাঁর সঙ্গে ফকির আলমগীরের ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কারণেই সম্ভবত কোনো বাঙালির জীবন নিয়ে যদি চলচ্চিত্র বানাতে হয়, সবচেয়ে সহজ হবে ফকির আলমগীরকে নিয়ে ছবি বানানো। প্রয়াণের পর আজ প্রথম জন্মদিনে তাঁর অনুপস্থিতি শূন্যতাবোধ তৈরি করে।
গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর ছিলেন নিঃশঙ্ক চিত্তের মানুষ, বলিষ্ঠ কণ্ঠের শিল্পী। বহু মানুষের ভিড়ে বহুদূর থেকে তিনি ভাস্বর হয়ে থাকতেন। গানে–স্লোগানে তিনি, বাংলা নতুন বছরে তিনি, ভাষাশহীদ দিবসে, স্বাধীনতা দিবস, মে দিবস, বিজয় দিবসের যেকোনো জাতীয় আয়োজনে তাঁর কণ্ঠ তাঁর গান ছিল অবসম্ভাবী। দেশের কোনো শিল্পীর প্রয়াণ বা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যাপনের দিনে ফকির আলমগীর উচ্ছল তারুণ্য নিয়ে হাজির থাকতেন। একক কণ্ঠস্বর হিসেবে তাঁর বয়ানে শোনা যেত প্রয়াত ব্যক্তির অবদানের কথা। গণমানুষের পক্ষের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তাঁর আগ্রহও ছিল অসীম। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে তাঁর গান তো এখনো শুনতে ভালো লাগে।
ইউটিউবের এই যুগে নতুন গান যখন এক সপ্তাহের বেশি টেকেই না বলা চলে, তখনো ‘ও সখিনা গ্যাছস কি না ভুইল্লা আমারে’ গানটি কেউ ভোলেনি। ১৯৮২ সালের বিটিভির আনন্দমেলা অনুষ্ঠানে প্রচারের পর গানটি সাড়া ফেলে দেয়। গানটির শিল্পী ও সুরকার ছিলেন ফকির আলমগীর। তাঁর গাওয়া ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’ গানগুলোয় আজও লেগে আছে তাঁর স্বকীয়তার ছাপ।
অনেকে ফকির আলমগীরকে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের ‘পঞ্চপাণ্ডব’–এর একজন বলতেন। বাকিরা হলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই ও আজম খান। বাংলা পপ গানের অন্যতম পুরাধা বললেও ভুল হয় না তাঁদের। ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে সংগীতের জগতে পদচারণ শুরু করেন ফকির আলমগীর। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের মঞ্চে গণসংগীত পরিবেশন করতেন। সরাসরি যুক্ত ছিলেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে।
অত্যন্ত সাংবাদিক–বান্ধব শিল্পী ছিলেন ফকির আলমগীর। সস্নেহ উৎসাহের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে, যথাযথ বক্তব্য দিয়ে সাহায্য করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা ফকির আলমগীর সাংবাদিক হতে না পারলেও এ অঙ্গনের মানুষদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। গানের পাশাপাশি নিয়মিত তিনি লিখতেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যাঁরা আছেন হৃদয়পটে’সহ বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। তিনি বইমেলায় ঢুকলে ভক্ত–শুভাকাঙ্ক্ষীদের হুড়োহুড়ি ছিল তাকিয়ে দেখার মতো আনন্দের দৃশ্য।
ফকির আলমগীরকে সম্মান–সম্মাননা জানাতে কার্পণ্য করেনি মানুষ, দেশ। সংগীতের অবদানের জন্য একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, ভাসানী পদক, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার, তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক, জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক, কান্তকবি পদক, গণনাট্য পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা, ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার, ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র, জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা, চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা ও বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ পেয়েছেন তিনি।
প্রয়াণের পর আজ ফকির আলমগীরের প্রথম জন্মদিনের সকালে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে তাঁর আত্মার শান্তির জন্য দোয়ার আয়োজন করেছে। সন্ধ্যায় বইমেলার মিডিয়া সেন্টারে সুহৃদেরা কেক কেটে তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন করবেন। গত বছরের ২৩ জুলাই তিনি প্রয়াত হন।