গ্লাসের টুংটাংকে তিনি শিল্পে পরিণত করলেন

উপমহাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি রাহুল দেববর্মন। তিনি ছিলেন একাধারে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক ও সুরকার। জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়, ত্রিপুরার এক সংগীতপ্রেমী রাজপরিবারে। আজ সুবিখ্যাত সুরকার ও শিল্পী রাহুল দেববর্মনের ৮৪তম জন্মদিন। ১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের। অসংখ্য জনপ্রিয় হিন্দি, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মন। জন্মদিনের সূত্রে তাঁকে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের সংগীতজগতের পরিচিত মুখ, অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। এখানে থাকল তাঁর লেখার তৃতীয় কিস্তি।

আজ ২৭ জুন রাহুল দেববর্মনের জন্মদিন

১৯৮০ সালে রাহুল ও আশা ভোসলে বিয়ে করেন। দুজনের প্রচুর হিট গান আছে। একদিন বেরিয়েছেন শপিং করতে। কিন্তু চলে গেলেন লং ড্রাইভে। ফেরার পথে আশা মনে করিয়ে দিলেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শপিং মলে গেলেন। কিন্তু দুটি মাত্র গ্লাস কিনে বাড়ি ফিরলেন। সেই দুই গ্লাস নিয়ে তিনি অন্য চিন্তা করলেন। এই চিন্তার ফলাফল অচিরেই সামনে এল। ছায়াছবি ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’ পরিচালনা করেন নাসির হুসেইন। অভিনয়ে ছিলেন ধর্মেন্দ্র, জিনাত আমান প্রমুখ। গান লিখেছেন মাজরুহ সুলতানপুরি। সংগীত পরিচালনা করেছেন রাহুল। এই ছবির একটি গানের শুরুতে রাহুলের কেনা দুই গ্লাসের চমক দেখা গেল। গ্লাসের টুংটাংকে তিনি শিল্পে পরিণত করলেন। গানটি ছিল, ‘চুরালিয়া হ্যা তুমনে জো দিলকো’। গেয়েছিলেন মোহাম্মদ রফি ও আশা ভোসলে।
‘শোলে’ ছবিতে খলনায়ক গব্বরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমজাদ খান। ছবিতে খলনায়কের প্রবেশের সময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটানা সাউন্ড ব্যবহার করেছেন রাহুল। এই সাউন্ড শুনলেই মনে অশুভ শঙ্কা জাগে। এই আওয়াজ গিটারের নয়। কি-বোর্ডের নয়। এই আওয়াজ প্রচলিত কোনো যন্ত্রের নয়। কুমার বিশ্বজিৎ জানান, আর ডি বর্মন পানিভর্তি হাঁড়ির ওপর পশুর রগ টান টান করে বেঁধে তার থেকে এই সাউন্ড বের করে আনেন।

আর ডি বর্মন

গুলজার পরিচালিত ‘কিতাব’ ছবির গান ‘মাস্টারজি কা আয়া চিঠি’ লিখেছেন গুলজার। এই গানে তালের উৎস হিসেবে ডেস্ক ব্যবহার করা হয়। এ জন্য কয়েক জোড়া ডেস্ক রেকর্ডিং স্টুডিওতে নিয়ে আসেন। রাহুল ‘প্যাডেল মটকা’ আবিষ্কার করেন।

হাঁড়ির ওপর চামড়া লাগিয়ে, প্যাডেল দিয়ে বাজানো হয়। নরেন্দ্র বেদি পরিচালিত ‘জওয়ানি-দিওয়ানি’ চলচ্চিত্রে আনন্দ বকশির কথায় করা গান ‘সামনে ইয়ে কওন আয়া’-তে প্রথম এই যন্ত্র ব্যবহার করেন।

‘শোলে’ ছবিতে খলনায়ক গব্বরের প্রবেশের সময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে স্বল্পদৈর্ঘ্যের সাউন্ড ব্যবহার করেছেন রাহুল

তারপর বহু গানে এই ‘প্যাডেল মটকা’ ব্যবহার করেছেন রাহুল। মিউজিকে দেশীয় ছোট ছোট নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য তিনি অত্যন্ত সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন। শ্রোতারাও আনন্দ ও মুগ্ধতার সঙ্গে এই ব্যতিক্রম মিউজিক গ্রহণ করেছেন।

পাঁচ মিনিটে ‘এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা’

আর ডি বর্মনের প্রথম স্ত্রীর নাম রিতা পাটেল। দার্জিলিংয়ে আলাপ। রিতা ছিলেন রাহুলের ভীষণ ভক্ত। ১৯৬৬ সালে বিয়ে। ১৯৭১ সালে ছাড়াছাড়ি। অনেকে মনে করেন, কেউ কেউ লিখেছেনও ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’ গানটি এই ছাড়াছাড়ির ফলেই সৃষ্ট হয়েছে। আসলে গান তো রাহুল লেখেননি। লিখেছেন গুলজার। তাই এই গল্প সত্যি বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। রাহুলের টিমের গিটারিস্ট ভানুগুপ্ত। প্রায় সময় রাহুলের সঙ্গে থাকতেন। রাহুল বাথরুমে গেছেন। রুমে বসে আছেন ভানুগুপ্ত। গিটার তুলে নিয়ে এমনিতেই টুংটাং করতে লাগলেন। বাথরুম থেকে রাহুল চিৎকার করে বললেন, ‘বাজাতে থাকো ভানু, থামবে না।’ পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই ভানুগুপ্তের বাজানোর ওপর সুর করলেন। সেই সুরের ওপর গুলজারের কথায় কিশোর কুমারের কণ্ঠে ‘পরিচয়’ ছবির জন্য গান তৈরি হয়, ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’। রাহুল খুব দ্রুতই অসাধারণ সব সুর করতে পারতেন। ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’ ছবির ‘এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা’ গান লেখা ও সুর নিয়ে জাবেদ আখতার স্মৃতিচারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন তাঁর লেখা গান নিয়ে ছবির পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া ও সংগীত পরিচালক রাহুলের সঙ্গে বসার কথা। কিন্তু তিনি তখনো গান লেখেননি।

গাড়িতে বসে তাঁর মাথায় একটি লাইন এল। বিনোদ ও রাহুলের সঙ্গে দেখা হলে জাবেদ বলেন, ‘গানের একটা আইডিয়া আছে, সেটা শোনাতে চাই।’ রাহুল শুনতে চাইলে জাবেদ বলেন, ‘ও এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা...’ রাহুল প্রশ্ন করলেন, তারপর কী? জাবেদ সময় নিলেন।

কলকাতায় জন্ম রাহুলের

পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘বললেন না তো আইডিয়াটা কেমন!’ রাহুল আর বিনোদ উভয়ের উত্তর, আইডিয়া তো ভালো, তারপর কী? জাবেদ তো লেখেননি, লেখা নিয়ে চিন্তাও করেননি। কিন্তু তিনি তো জাবেদ আখতার। মাথায় তখনই যা এল, তা-ই বললেন, ‘য্যায়সে খিলতা গুলাব য্যায়সে শায়ের কা খাব য্যায়সে উজলি কিরণ য্যায়সে বন মে হিরণ য্যায়সে চান্দনি রাত য্যায়সে নরমি কি বাত য্যায়সে মন্দির মে হো এক জ্বলতা দিয়া.... এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা।’

এইভাবে একটির পর একটি লাইন বলতে লাগলেন। রাহুল লিখতে লাগলেন। জাবেদ জানাচ্ছেন, যেকোনো ভাষার গান সুর করার আগে, গানটি রাহুল বাংলায় লিখে নিতেন। জাবেদের বলা শেষ, রাহুলের লেখা শেষ। সুর তৈরি। হারমনিয়াম টেনে নিয়ে রাহুল সুর শুনিয়ে দিলেন। জাবেদের কথামতো রাহুল গানের কথা বাংলায় লিখতে লিখতেই, সুর তৈরি করে ফেলেন। বিধু বিনোদ চোপড়া জানান, পুরো গানটা তৈরি হতে পাঁচ মিনিট সময় লেগেছিল। ১৯৯০-এর শেষ দিক থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত রাহুলের সময়টা খারাপ যাচ্ছিল। রাহুল সংগীত পরিচালনা করেছেন, এমন কিছু ছবি ফ্লপ করেছে। ছবির গানও ফ্লপ। একসময় যেখানে প্রযোজক, পরিচালক ও মিডিয়ার লোকজনেরা তাঁকে ঘিরে থাকতেন, সেখানে তাঁকে একা সময় কাটাতে হচ্ছিল। অভিমান ছিল। অপেক্ষা ছিল একটি সুযোগের। বিধু বিনোদ চোপড়া তাঁকে সে সুযোগ দিলেন। ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’র সব গান হিট। রাহুল আবার স্বমহিমায়। এই ফিরে আসা তাঁর দেখা হলো না। ছবি মুক্তির আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন। তারিখ ছিল ৪ জানুয়ারি ১৯৯৪।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন