গণসংগীতে ওর বিকল্পই তো নাই
১৯৭৩ সালে টিএসসিতে ফিরোজ সাঁইয়ের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়। সেই হিসাবে ৪৮ বছরের সম্পর্ক। তখন সে গণসংগীত গাইত। দ্রুতই সে পপসংগীতে চলে এল। তখনো ও বিয়ে করে নাই। প্রায়ই আমাদের ধানমন্ডির বাসায় আসত। আড্ডা হতো। আস্তে আস্তে ওকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। ফকিরের মধ্যে মোহনীয় একটা ব্যাপার ছিল। এত আদর করে ডাক দিত যে সাড়া না দিয়ে উপায় ছিল না। দেখলাম, ও আমাকে টানতে পারছে। এই টানার ক্ষমতা সবার নাই।
ফলে দুই বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও অচিরেই ফকির আলমগীরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়ে গেল তুই-তুই। একসঙ্গে অনুষ্ঠান করি। ১৯৭৮ সালে বিয়ের সময় ফকির আলমগীর আমাকে বলল, তোকে ছাড়া যাবই না। আমিও গেলাম। ৫ দিন সঙ্গে ছিলাম।
ওর বিয়ের পাগড়িটাও আমার পরানো। এটাই ফকিরের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বড় স্মৃতি। বিয়ের পর আমাদের বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। আন্তরিকতা বাড়ে। তখন পরিবেশটাও ছিল ভালো। একের সঙ্গে অন্যের বিদ্বেষ ছিল না।
আমাদের পেশাদার গানবাজনা শুরুর সতেরো বছর পর, আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফকির আলমগীর ও ফেরদৌস ওয়াহিদ—আমরা ৫ জন প্রথমবার একসঙ্গে মিলিত হই। এর আগে আমরা ৫ জন একসঙ্গে কোথাও গাইনি। কখনো আমি–ফিরোজ। কখনো আজম-ফকির। মাঝেমধ্যে পিলু মমতাজ যুক্ত হতো। একসঙ্গে ওই প্রথম, ওই–ই শেষ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দুদিনব্যাপী বিশাল অনুষ্ঠান হয়। আমরা সাত দিন রিহার্সাল করি। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টিকিটের বিনিময়ে শো হয়েছিল।
দেশে ও দেশের বাইরে ফকিরের সঙ্গে কত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। মালদ্বীপের একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। দেখা যেত, আমি তাড়াতাড়ি সকালের নাশতা খেয়ে চলে এলে ধমক দিত, তুই আমাকে রেখে চলে গেছিস কেন? আবার কোনো সময় সে একলা খেয়ে এসে বলত, যা যা, খাইয়া আয়। শেষ হইয়া যাইব তো।
গত ৫ জুন আমাদের আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে শেষ দেখা। অনেক কথা হলো সেদিন। ফোনে আমাদের নিয়মিত কথা হতো। হয় সে, না হয় আমি ফোন করতাম। ফেসবুক ব্যবহার শুরুর পর তো আমাদের খুব মেসেজ চালাচালি হতো। পোস্টে কমেন্ট, পাল্টা কমেন্ট করতাম। ওকে ঘিরে কোনো পোস্ট দিলেই অনেকে ফোন করত। এমন এমন সব মানুষ ফোন করত, যাদের ফোন আশাই করিনি। তখন নতুন করে আবার উপলব্ধি করলাম, ওর প্রতি মানুষের একটা অন্য রকম আকর্ষণ আছে। প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতে পারত। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের এই যোগ্যতা আমাদের আর কারোরই ছিল না।
কথায় কথায় অনেক শুনেছি, জিরো থেকে হিরো। ফকির আলমগীর সেটা আমাদের করে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। ওর জীবনটাকে আমি বলব অনুকরণীয়। গানের জগতে সে নিজের চেষ্টায় সবকিছু করেছে। ব্যক্তিজীবনেও নিজের চেষ্টায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, পরিবারকে নিরাপত্তা দিয়ে গেছে। ফকির আলমগীর নিজের টাকায় নিজে ফুটানি করে গেছে।
ফকির আলমগীরের মৃত্যুতে আমার প্রথম উপলব্ধি, ওর সঙ্গে সঙ্গে গণসংগীতটাও চলে গেল। সংগীতের এই বিভাগটা একমাত্র সে-ই ধরে রেখেছিল। অনেকেই হয়তো গণসংগীত করে, কিন্তু দেশব্যাপী সবাই একজনকেই চেনে—সে হচ্ছে ফকির আলমগীর। এটা আবার কবে কার হাতে আসবে, এটা জানি না। একেবারে শূন্য হয়ে গেল। যে কারণে আমি সব সময় ফকিরকে বলি বাংলা সংগীতের বাঘ। পপসংগীতে আমরা সবাই প্রায়ই সমান, কিন্তু গণসংগীতে ওর বিকল্পই তো নাই।