‘ক ফোঁটা চোখের জল’, ‘তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন’, ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন’, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, ‘বহুদূর থেকে এ কথা’, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়’, ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব হারিয়ে যাব’, ‘মা মাগো মা, মা গো মা, আমি এলাম তোমার কোলে’সহ বহু গানের গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটা হয়তো চট করে অচেনা মনে হতে পারে। কিংবা চেনাচেনা—মনে হয় কোথায় যেন শুনেছি। ‘ক ফোঁটা চোখের জল’, ‘তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন’, ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন’, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, ‘বহুদূর থেকে এ কথা’, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়’, ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব হারিয়ে যাব’, ‘মা মাগো মা, মা গো মা, আমি এলাম তোমার কোলে’...। এই গানগুলো শোনেননি, এমন বাঙালি সংগীতানুরাগী মিলবে কম। এগুলো ছাড়া বহু জনপ্রিয় বাংলা গানের গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
২১ বছর আগে, ১৯৯৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গঙ্গা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরেফিরে এসেছেন তিনি। এদিন ছিল গীতিকবির চলে যাওয়ার দিন।
তাঁর সময় তথা আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে দুটি নাম পাশাপাশি উচ্চারিত হতো—পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। অবশ্য পুলকের সঙ্গে আরও একটি নাম উচ্চারিত হয়, মান্না দে। মান্না দে পুলকের লেখা যত গান করেছেন, অন্য কারও লেখা তত গান করেননি। হেমন্তের গাওয়া সুপারহিট বহু গান আছে, যেগুলো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। ‘খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার’, ‘এক মুঠো রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম, চললাম’ সে রকম দুটি। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমি তোমার কাছে ফিরে আসব’, ‘ধর কোনো এক গানের পাখি’ গান দুটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিংবা আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘যদি আকাশ হতো আঁখি’, ‘ওগো বন্ধু আমার আঁধার রাতে যদি এলে’ গান দুটি উল্লেখযোগ্য!
হৈমন্তী শুক্লার কথাটা বলে ফেলি এই ফাঁকে। তাঁকে নিয়ে ইংল্যান্ডে গান গাইতে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ফিরে এলে শুরু হলো বিতর্ক। হেমন্তের স্ত্রী বেলা বাড়ি থেকে প্রায় তাড়িয়েই দিলেন হৈমন্তীকে। ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংসের পথে তখনকার উঠতি গায়িকা হৈমন্তীর। ধরলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি নিয়ে গেলেন মান্না দের কাছে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই লেখা দুটি গান ছিল মান্না দের কাছে। সেই গান দুটির সুরও করা ছিল। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মান্না দে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে গান দুটি দিলেন হৈমন্তীকে। ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ এবং ‘ঠিকানা না রেখে ভালোই করেছ বন্ধু’। হৈমন্তী গাইলেন। আবার প্রাণ ফিরে পেল তাঁর সংগীতজীবন।
১৯৮৭ সালের কথা। অক্টোবর মাস। কিশোর কুমার মারা গেছেন। কুমার শানু তখন মুম্বাইতে। তাঁর গুরু ছিলেন কিশোর কুমার। কুমার শানু তখন সংগ্রাম করছেন মুম্বাইতে জায়গা করে নেওয়ার সংগ্রাম। গুরুকে স্মরণ করে কিছু একটা করতে চাইলেন। গেলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর জন্য পুলক লিখলেন ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার, তোমায় জানাই প্রণাম’। সুপারহিট হলো সেই গান এবং কুমার শানু নিজে।
তাঁর লেখা গানগুলো শুনে সহজে বলা যায়, গানগুলোর বিশেষত্ব হলো প্রাণোচ্ছ্বাস। যেকোনো ঘটনাকে তিনি সুন্দর ছন্দে ফেলে গানে রূপ দিতেন। তাঁর গান শুনে বোঝা যেত কতটা সাবলীল দৃশ্য বা পরিস্থিতি অনুযায়ী গান লিখতেন তিনি। অন্যের সুরের ওপর ছন্দ ফেলে গান লেখায় তিনি ছিলেন দারুণ দক্ষ। চলচ্চিত্রের গানের জন্য এটা খুব দরকার। এ কারণে হঠাৎ গানের দরকার হলেই ডাক পড়ত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গানগুলোর কথা লিখতে গেলে এ রচনা আরও দীর্ঘ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের গল্প বলা যাক।
১৯৩১ সালের ২ মে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার সালকিয়াতে তাঁর জন্ম। বাবা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন, অভিনয়ও করতেন। বাবার শিল্পীজীবনের সূত্রে পুলকদের বাড়িতে অনেক শিল্পীর যাওয়া-আসা ছিল। অভিনেতা, গায়ক, সুরকারদের আড্ডা জমত তাঁদের বাড়িতে। এসবের ভেতর বেড়ে ওঠা পুলকের মধ্যে সৃষ্টিশীল নানা কাজের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। স্কুল ও বাড়িতে গান, নাটক, আবৃত্তির অনুষ্ঠানে পুলক সক্রিয় ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গান লেখার প্রতি এমন ঝোঁক ছিল যে একবার শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে হাওয়া বদলে চলে যান বোনের বাড়ি ঘাটশিলায়। উদ্দেশ্য, লেখাপড়ার চাপ এড়িয়ে গান লেখা। এক মাস পরে যখন ফিরে এলেন বাড়িতে, সঙ্গে নিজের লেখা পঁচিশটি গান। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি। একবার তাঁর লেখা একটি কবিতা আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হলো। সম্মানী হিসেবে মানি অর্ডারে পাঁচ টাকা পেয়েছিলেন। কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর ‘গীতিকবি’ হয়ে ওঠা। স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিকের পড়াশোনা শেষ করেন পুলক। এরপর কলকাতার নামকরা স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে নেন স্নাতক ডিগ্রি।
পুলক গিয়েছিলেন গায়ক মান্না দের বাড়িতে। দেখেন, মান্না রান্না করছেন। রসুইঘরে মান্না দেকে দেখে গীতিকার পেয়ে গেলেন নতুন গান। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে ফেলেন ‘আমি শ্রী শ্রী ভজ হরি মান্না’। ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে ছিল গানটি।
আবার গানের প্রসঙ্গে আসি। গানেই তো তাঁর প্রথম এবং শেষ পরিচয়। চার হাজারের বেশি গান লিখেছেন। ক্লাস টেনে পড়ার সময় অভিমান ছবির জন্য গান লিখেছিলেন। সে সময়ের বিখ্যাত সুরকার আর সি পাল বা রাম চন্দ্রপাল। গানগুলো তিনি পোস্টে পাঠিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে গীতিকারকে দেখে আর সি পাল দ্বিধায় পড়ে গেলেন, সত্যিই কি এই ছোকরা গান লিখেছে? নিশ্চয়ই অন্যের গান নিজের বলে চালাচ্ছে। পরে স্টুডিওতে বসেই গান লিখে দেখাতে হলো পুলককে।
লেখা বাহুল্য, পুলকের লেখা গান সবচেয়ে বেশি গেয়েছিলেন মান্না দে। গানের ব্যাপারে মান্না দে খুঁতখুঁতে ছিলেন। গানের কথা, বাক্য, শব্দ পছন্দ না হলে গাইতেন না। তবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সেসব ছিল না। বিনা প্রশ্নে গাইতে রাজি হয়ে যেতেন। ‘আমি শ্রী শ্রী ভজ হরি মান্না’ গানটি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, প্রথম কদম ফুল ছবিতে ছিল। এই গান নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে। পুলক গিয়েছিলেন গায়ক মান্না দের বাড়িতে। দেখেন, মান্না রান্না করছেন। রসুইঘরে মান্না দেকে দেখে গীতিকার পেয়ে গেলেন নতুন গান। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে ফেলেন বিখ্যাত ওই গানটি।
সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। নচিকেতার সুরে ধন্যি মেয়ে ছবির ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’ গানটি শোনেনি, এমন শ্রোতা পাওয়া কঠিন হবে। এ ছাড়া ‘আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে’, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’ গানগুলোও দারুণ জনপ্রিয়।
জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত থেকেই যেন গানের কথা বের করে আনতেন পুলক। পরিস্থিতি এবং গানের মিটার বুঝে অল্প সময়ে গান লেখা তাঁর বাঁ হাতে খেলা! সে রকম কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা যাক। একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে ভুলবশত অন্য বাড়ির কলবেল টিপে দিলেন পুলক। এক নারীকে হাসিমুখে বের হতে দেখে তিনি লিখে ফেলেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো, অমনি করে ফিরে তাকাল’! একবার দুর্গাপূজায় তিনি গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হেমন্তর বাড়িতে পৌঁছালেন, তখন হেমন্ত ছিলেন গোসলখানায়। বাড়িতে পুলক এসেছে শুনে, তড়িঘড়ি করে প্রায় ভিজে শরীরে সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘কত দিন পরে এলে, একটু বসো, তৈরি হয়ে আসি।’ ব্যস, এই বাক্যগুলো মনে ধরে গেল তাঁর। হেমন্ত সেখান থেকে সরতেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন পুলক। লিখলেন, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোন’। সে গান তো হেমন্তের কণ্ঠেই টিকে আছে এখনো।
বিমানভ্রমণে এক বিমানবালাকে দেখে তিনি লেখেন, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’। একবার এক অনুষ্ঠানে এক নারীর কান থেকে ঝুমকো খুলে পড়ে গেল। সেটি কুড়িয়ে নিয়ে তিনি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। লিখে ফেললেন, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি ঝরে পড়েছে’। এভাবেই যেকোনো মুহূর্তকে অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে গান লিখে ফেলতেন তিনি।
গান শেষে কিশোর কুমার তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাবেন। এবার সিঁড়িতে তাঁকে আটকানো হলো। আরেকটি গান গাইতে হবে। মনের বিরুদ্ধে কিশোর কুমার আবার ঢুকলেন। গাইলেন, ‘আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ মোছায় অন্ধকার। ওরে গান গেয়ে যা, যা সুর দিয়ে যা...’। গান শেষে চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে কিশোর কুমার বললেন, পোলাও বাবু গানটা দারুণ লিখেছেন, একেবারে তাল মিছরির মতো মিষ্টি!
আরেক দিনের গল্প। একবার বাড়িতে এঘর–ওঘর ঘুরছেন। এমন সময় নচিকেতা ঘোষের ফোন। জানতে চাইলেন, কোনো নতুন গান আছে নাকি? পুলক শোনালেন দুটি লাইন। নচিকেতা ঘোষ তখনই তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। যেতে যেতে পুরা গানটি লিখলেন। মান্না দে গেয়েছিলেন ‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ’ নিয়ে।
শুধু সময়কে ধরে না, সময়কে এড়িয়ে বিপরীত ভাবের গানও লিখতেন তিনি। খুব ফুটবল ভালোবাসতেন। ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক। মাঠে চলে যেতেন প্রায়ই, মোহনবাগানের খেলা মিস করতেন না। একদিন খেলা চলছিল, গ্যালারিতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরতিতে একটা কাগজ কুড়িয়ে লেখা শুরু করলেন। খেলাসংক্রান্ত কিছু নয়। পরে মান্না দে সে গান গেয়েছেন,‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’। বিপরীত পরিবেশে বসেই লিখে ফেললেন রোমান্টিক গান। লতা মঙ্গেশকরের জন্য একটি গানের ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছিল। এক রেস্তোরাঁর ন্যাপকিনে লিখেছিলেন, ‘রঙ্গিলা পাখিরে কে ডাকে ঘুম ঘুম…।’
আরেকটা ঘটনা বলি, মান্না দে’র সঙ্গে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মান্না দে–কে নিয়ে ফিরছিলেন। পথে মান্না একটি ঠুমরি গুনগুন করছিলেন। ঠুমরিটি মান্না দের চাচা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে শেখা, ‘শ্যাম, ঘুংঘটকে পট খোলো।’ হঠাৎ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মান্না দে বললেন, ‘এই রকম একটা গান লেখা যায় না।’ গাড়ি ততক্ষণে শ্যামবাজারে। পুলক বললেন, ‘গানটা এসে গেছে মশাই, চলুন, এখনই করে ফেলা যাক। কাছেই গানের স্কুল বাণীচক্র। সেখানে গিয়ে একটি ঘর চেয়ে নিয়ে, হারমোনিয়াম আর খাতা–কলম নিয়ে বসে পড়লেন দুই শিল্পী। তৈরি হলো নতুন এক গান ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’। এমন ঘটনা আরও আছে। মান্না দে সেদিন একটা কাওয়ালি শুনিয়েছিলেন। কাওয়ালি শেষ হতেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, এর ঠিক ভাবটা কী বুঝিনি, পাগল নাকি! মান্না দে বললেন, ‘কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আমায় পাগল বলবে।’ তবে হ্যাঁ, বলেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, আপনি বললে আলাদা কথা...। শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো কথা বললেন না। কেননা তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন। সেদিন লিখেছেন, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’।
সে সময়ের বোম্বের অনেক শিল্পীর প্রথম বাংলা গান পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। লতা মঙ্গেশকর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিক, কিশোর কুমারের সঙ্গে দারুণ সখ্য ছিল তাঁর। তাঁকে পোলাও বাবু ডাকতেন। মুম্বাইয়ে একবার কিশোর কুমারের গান হবে। প্রতিশোধ ছবির। অনেক কষ্টে তাঁর শিডিউল পাওয়া গেল। মেহবুব স্টুডিওতে প্রথম গানটি রেকর্ডিং হলো ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’। গান শেষে কিশোর কুমার তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাবেন। এবার সিঁড়িতে তাঁকে আটকানো হলো। আরেকটি গান গাইতে হবে। মনের বিরুদ্ধে কিশোর কুমার আবার ঢুকলেন। গাইলেন, ‘আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ মোছায় অন্ধকার। ওরে গান গেয়ে যা, যা সুর দিয়ে যা...’। গান শেষে চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে কিশোর কুমার বললেন, পোলাও বাবু গানটা দারুণ লিখেছেন, একেবারে তাল মিছরির মতো মিষ্টি!
আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি, আর যত দিন বাঁচব, তত দিন এই আধুনিক গানই লিখে যাব। আমি কবি ছিলাম কি না জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনিপুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
এমন সাধুবাদ তিনি অনেক পেয়েছিলেন একজীবনে। সংগীত পরিচালকদের চোখের মণি ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ জীবনে কী যে হলো! সেই তাল মিছরির মতো মিষ্টি গান লেখা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ভীষণ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর কাছের বন্ধুদের থেকেই জানা যায়, শেষের দিকে আর লিখতে পারতেন না পুলক। বেঁচে থাকার ইচ্ছাই হয়তো শেষ হয়ে আসছিল। ১৯৯৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
তাঁর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত চলে যাওয়ায় অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। সে ঘটনার দুই দিন আগে ৫ তারিখে লিখেছিলেন, ‘আমাকে একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি।’ কী কারণে নিজেকে হত্যা করেছিলেন, সে রহস্য আজও অজানা। তিনি কি কারও ব্যবহারে আঘাত পেয়েছিলেন, পারিবারিক অশান্তি ছিল? কেউ জানতে পারেনি আজও। সে সময় অনেকে এমনটাও জানিয়েছেন, শেষ দিনগুলোতে নাকি ঘাটে বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মৃত্যুর পর মান্না দে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জীবনরসিক পুলক এই ঘটনা ঘটাবে, আমার কাছে অকল্পনীয়। সে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিল!’
অবশ্য একটা আক্ষেপের কথা নিজেই জানিয়েছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী কথায় কথায় রাত হয়ে যায়–এ লিখেছেন, ‘আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি, আর যত দিন বাঁচব, তত দিন এই আধুনিক গানই লিখে যাব। আমি কবি ছিলাম কি না জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনি।’ কী জানি, হয়তো এই আক্ষেপই বাংলা গানের পুলককে বিষণ্নতার রোগী বানানোর বীজ বপন হয়েছিল।