কথা ও সুরের কী সুন্দর মেলবন্ধন!
উপমহাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি রাহুল দেববর্মন। তিনি ছিলেন একাধারে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক ও সুরকার। জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়, ত্রিপুরার এক সংগীতপ্রেমী রাজপরিবারে। আজ সুবিখ্যাত সুরকার ও শিল্পী রাহুল দেববর্মনের ৮৪তম জন্মদিন। ১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের। অসংখ্য জনপ্রিয় হিন্দি, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মন। জন্মদিনের সূত্রে তাঁকে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের সংগীতজগতের পরিচিত মুখ, অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। এখানে থাকল তাঁর লেখার দ্বিতীয় কিস্তি।
শ্রোতাদের প্রিয় বাংলা গানের তালিকায় রাহুলের সৃষ্ট বাংলা গানের ব্যাপক উপস্থিতি সব সময় ছিল, এখনো আছে। ১৯৬৯ সালে শচীন ভৌমিকের লেখা ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ ও ‘ফিরে এসো অনুরাধা’ গান দুটো রাহুলের সুরে ও কণ্ঠে প্রকাশিত হয়। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’-এর সুরে কান্না নেই। কিন্তু মোচড় দেওয়া বেদনা আছে। ভেতরের বেদনাকে সুরের খেলায় কী সুন্দরভাবেই না রাহুল নিয়ে এসেছেন! আসলে ভালো গান, গাইতে সহজ হলে, শ্রোতারা নিজের মতো করে গুনগুন করে গাইতে থাকেন। এ ধরনের গান তখনকার সময় খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতো। ব্যাপক জনপ্রিয় ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ সে ধরনের একটি গান। অন্যদিকে ‘ফিরে এসো অনুরাধা’র স্থায়ী ও অন্তরার এমনই সুর, এমনিই গায়কি, শুনলেই মনে হবে অন্তরের আর্তনাদ প্রেমিকার কানে পৌঁছে যাচ্ছে। এই গান গাওয়ার জন্য মোটেও সহজ গান নয়। কিন্তু এই গানও বিপুলভাবে প্রায় সব শ্রোতার হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায় আশা গাইলেন, ‘হায় রে পোড়া বাঁশি....রইতে দিল না ঘরেতে’। গানের শুরুতেই আশার কণ্ঠের ‘হায়’ শব্দ, শ্রোতাকে মুহূর্তেই গানের মূল ভাবের সঙ্গে যুক্ত করে। একটি শব্দে গানের ভাব ধারণ করা একমাত্র রাহুলের পক্ষেই বোধ হয় সম্ভব।
আবার স্বপন চক্রবর্তীর লেখা ‘তুমি কত যে দূরে’র প্রিলিউড শ্রোতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহু দূরে। সেখান থেকেই রাহুল শ্রোতার মনে তোলপাড় তুলে গানের প্রথম লাইন শুরু করেন। গানের সঙ্গে শ্রোতার একাত্ম না হয়ে কোনো উপায় থাকে না।
রাহুল ছাড়া এই গান আর কারও পক্ষে গাওয়া প্রায় অসম্ভব। আশা ভোসলে যখন এই গানে প্রবেশ করেছেন, তখন নোটের যে পরিবর্তন করা হয়েছে, তা চিন্তাও করা যায় না। এই নোট পরিবর্তন নিয়ে খ্যাতিমান সুরকার নকীব খান বলেন, ‘এত চমৎকারভাবে আর ডি এই গানে নোট পরিবর্তন করেছেন, না শুনলে বিশ্বাসই হতো না। পুরো গানের কম্পোজিশনের কোনো তুলনা হয় না।’
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’। গেয়েছেন আশা ভোসলে। এই গানে ক্লাসিক্যাল, লোকসংগীতকে তিনি একাকার করেছেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আরেকটি গান:
‘যেতে যেতে পথে হলো দেরি/ তাই তো পারিনি, যেতে পারিনি।’ গানের শুরুতে মেজর সেভেন নোট ব্যবহার করলেন রাহুল। সংগীতশিল্পী নকীব খানের মতে, গানের শুরুতে মেজর সেভেন নোট সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। যেতে দেরি হয়ে যাওয়ায় এবং সে কারণে প্রেমিকার চলে যাওয়ার অসহায়ত্ব আর দুঃখবোধ গানের স্থায়ী ও অন্তরার সুরে সর্বোত্তমভাবে এসেছে। আর রাহুলের ব্যতিক্রমী গায়কি তো গানের জন্য সব সময় বড় এক সম্পদ।
‘সজনী গো প্রেমের কথা প্রেমের ব্যথা
জানে বলো কয়জনা’—স্বপন চক্রবর্তীর লেখা এই গানের সুরে আধুনিকতার সঙ্গে লোকগীতির ছোঁয়াও আছে। প্রথম অন্তরায় ‘ভাঙলে জোড়া লাগে তামা–পিতল, মন ভাঙলে জোড়া লাগে না’, এই ‘জোড়া লাগে না’য় এসে জোড়া না লাগার কষ্ট গায়কিতে অপূর্বভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাহুল। গানের সুর তো আছেই, অলংকার হিসেবে গানে যোগ করা ছোট ছোট নিরীক্ষাও এককথায় অসাধারণ।
মুক্তিযুদ্ধের সময়। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান প্রচারমাধ্যম। খবরের পাশাপাশি দেশের গান, সংগ্রামী গানও এই কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো। এ ধরনের গানের কথা হতো দেশাত্মবোধক, তেজস্বী ও উদ্দীপনামূলক। সুরও একই ধারায় হতো, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে প্রতিনিয়ত মানসিক শক্তি জোগাত।
কিন্তু রাহুল তো সব সময় অন্য রকম কিছুই করেন। তিনি একটি গান করলেন। শিরোনাম—‘স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে, স্মৃতিটুকু মনে আছে’। ১৯৭১ সালে প্রকাশ পাওয়া এই গানের কথায় সংগ্রামী কোনো বাণী নেই। কিন্তু একটি সংসার গুঁড়িয়ে দেওয়ার গল্প আছে। এই সংসার গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্মম গল্প সে সময় প্রতিদিনই শোনা যেত। গানের অন্তরায়, হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া যুবক তাঁর ছিনিয়ে নেওয়া বউয়ের কথা বলতে গিয়ে বউয়ের গাওয়া গান গেয়ে শোনান। এই অংশটুকু রাহুল ফোকের আদলে সুর করেছেন। কী চমৎকার সুর, কথা ও সুরের কী সুন্দর মেলবন্ধন!
আবার এই গানেরই স্থায়ী সুর করেছেন, একেবারেই আধুনিক আদলে। স্থায়ী শোনার সময় কেউ চিন্তাও করতে পারবেন না যে অন্তরায় কী সুর অপেক্ষা করছে। ‘জানি না কোথায় তুমি হারিয়ে গেছ’—এই গান মেজর কর্ড দিয়ে শুরু। ব্রিজলাইন ও অন্তরায় গিয়ে মাইনর কর্ডে ট্রানজিশন। গতানুগতিকতার একদম বাইরে। নকীব খানের মতে, কর্ডের এ ধরনের ব্যবহার ও সুরের মাধ্যমে দূরের ব্যাপারটা এত সুন্দরভাবে ব্লেন্ড করা হয়েছে যে একবার শুনলে এই গান বারবার না শুনে উপায় থাকে না।
রাহুলের প্রতিটি গানেই ব্যতিক্রমী প্রতিভার ছোঁয়া, সুরের বৈচিত্র্য থাকবেই। সুরের ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট গান শ্রোতার কাছে কখনো একঘেয়ে মনে হয় না। প্রতিটি গানই যেন আলাদা। যেমন কেউ যদি রাহুলের সুর করা গান ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’, ‘চোখে চোখে কথা বলো’, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’, ‘যাব কী যাব না’ বা ‘মালতীলতা কী আবেশে দোলে’ পরপর শোনেন, তাহলে তাঁর কাছে প্রতিটি গানই নতুন আনন্দ হয়েই ধরা দেবে। এখানেই রাহুল অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং সব মিলিয়ে অপার বিস্ময়।