আলম খানের বিখ্যাত সব গানের গল্প
বরেণ্য সুরকার আলম খান। শুক্রবার বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে রাজধানী শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। অসংখ্য কালজয়ী গানের এই সুরকার এ পর্যন্ত তিন শ ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। সুর করা গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের ওপরে। তাঁর লেখা শ্রোতাপ্রিয় গানও অসংখ্য। তাঁর জীবনকালে এই গুণী সুরকারের কাছ থেকে শ্রোতাপ্রিয় কিছু গানের গল্প শুনেছেন গীতিকবি কবির বকুল। লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।
আলম খান বলেন, ১৯৭০ সালে আমি প্রথম চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার সুযোগ পাই। ছবির নাম কাঁচ কাটা হীরে। পরিচালক আবদুল জাব্বার খান। কিন্তু ছবির কাজ করতে করতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। আমার প্রথম শ্রোতাপ্রিয় গান স্লোগান ছবির; মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘তবলার তেড়ে কেটে তেড়ে কেটে তাক’ ও আবদুল জাব্বারের গাওয়া ‘কী সুখ পাও তুমি আমাকে ধুঁকে ধুঁকে পুড়িয়ে’। দুটো গানেরই গীতিকার ছিলেন এই পরিচালক কবীর আনোয়ার।
তবে কালজয়ী গান হিসেবে প্রথমেই বলব আবদুল জাব্বারের গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’ সারেং বউ ছবির এই গানটির কথা। গানটির যে সুর, সেটি আমার ১৯৬৯ সালে করা। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি।
আমি মনের মতো কোনো দৃশ্য পাইনি বলে কোনো ছবিতে সুরটি ব্যবহার করতে পারিনি। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে যখন আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর ‘সারেং বউ’ ছবির গান নিয়ে বসলেন, তখন গল্প শুনে মনে হলো, এই ছবির সারেংয়ের বাড়ি ফেরার দৃশ্যে সুরটি ব্যবহার করা যায়। গীতিকার মুকুল চৌধুরী ও আমি দুজনই এই ছবির পুরো গল্প পড়ে নিই। এরপর মুকুল চৌধুরীকে এই সুরটা দিয়ে বললাম গান লিখতে। তিনি দুই দিন পর অন্তরাসহ লিখে নিয়ে এলেন। আমি মামুন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করলাম। এই গানে ১২ জন রিদম প্লেয়ারসহ ২৪ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী বাজিয়েছিলেন।
‘রজনীগন্ধা’ ছবির ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’ সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া এই গানটির কথাও এসে যায়। পরিচালক কামাল আহমেদের সঙ্গে এটাই প্রথম কাজ। দৃশ্য শুনে প্রথমে সুর করলাম। সুরের ওপর গীতিকার মাসুদ করিম কথা লেখার পর পরিচালককে গেয়ে শোনালাম। তিনি সুর শুনে বাইরে গিয়ে অন্যদের বললেন, তাঁর গানটি পছন্দ হয়নি। এই সুর তিনি নেবেন না। শুনে বললাম, এই সুর না নিলে আমিও গান করব না। পরে তিনি রাজি হলেন। কিন্তু গান রেকর্ডিংয়ের দিন এলেন না। গানটি রেকর্ডের পর তিনি শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘নাগ পূর্ণিমা’ ছবির ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে, সে কি জানো না’ গানটির কথাও মনে পড়ে। নাগ পূর্ণিমা ফোক ফ্যান্টাসি ছবি। কিন্তু পরিচালক ও প্রযোজক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা বললেন, ‘আমি একটা রক গান করতে চাই এ ছবিতে।’ সিকোয়েন্স শুনে বললাম, রক গান ছবির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। তিনি বললেন, ‘আপনি ম্যাচ করাতে পারবেন বলেই তো গানটা করতে চেয়েছি।’ গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, ‘ছবির পেক্ষাপট অনুযায়ী একটা লাইন পেয়েছি; “তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না”।’ মুখটা তখনই সুর করি। অন্তরার সুর পরে করা। গানটি গাওয়ার পর শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের গলা বসে যায়। সাত দিন সে আর কোনো গান গাইতে পারেনি।
‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানটি বড় ভালো লোক ছিল ছবির। এই ছবির সবগুলো গানই লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। মনে আছে, গানের প্রথম চারটি লাইন একটা ছোট কাগজে লিখে হক ভাই আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ছবির স্ক্রিপ্ট লিখছি। আপনি মুখটা সুর করতে থাকেন।
স্ক্রিপ্ট শেষ হলে বসে গানটা শেষ করব।’ আমি কাগজটা মানিব্যাগে রেখে দিলাম। সময় পেলে মাঝেমধ্যে সুর করতাম। প্রায় ১৫টা সুর করেছিলাম। এখন সে সুরটা পরে এটাই মনে ধরল। তিন মাস পর হক ভাই একসকালে তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। মুখের সুর শোনার পর তিনি অন্তরা লিখে দিলেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও মনমতো অন্তরার সুর করতে পারলাম না। মন খারাপ করে আমার সহকারী গোপীসহ বাড়ি ফিরলাম। বাসায় ফিরে গোসল করতে তোয়ালে কাঁধে যখন বাথরুমে ঢুকব, তখনই সুরটা মাথায় এল। দ্রুত বেরিয়ে সুরটা রেকর্ড করলাম। পরদিন গিয়ে শোনালাম। হক ভাই শুনেই বললেন, ‘আপনি “পূর্ণিমাতে ভাইস্যা গেছে” বলে যে টান দিয়েছেন, তাতেই মন ভরে গেছে।’ এরপর আমরা গানটির রেকর্ডিংয়ে যাই।
শ্রোতাপ্রিয় কিছু গান
১. এক চোর যায় চলে
২. তুমি আছ সবি আছে
৩. চাঁদের সাথে আমি দেব না
৪. ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে
৫. সবার জীবনে প্রেম আসে
৬. তেল গেলে ফুরাইয়া
৭. ভালোবেসে গেলাম শুধু
৮. কী জাদু করিলা
৯. তোমরা কাউকে বোলো না
১০. আমি একদিন তোমায় না দেখিলে
১১. বুকে আছে মন
১২. কারে বলে ভালোবাসা
১৩. তোরা দেখ দেখ রে চাহিয়া
১৪. জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প
১৫. চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম
১৬. তুমি ছিলে মেঘে ঢাকা চাঁদ
১৭. এখানে দুজনে নিরজনে
১৮. মনে বড় আশা ছিল
১৯. কাল তো ছিলাম ভালো
২০. আমি তোমার বধূ