আইয়ুব বাচ্চুর 'সেই তুমি...'
‘সেই তুমি’ গানটি মালিবাগের একটি বাড়িতে বসে লিখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি তখনো জানতেন না এটি কতটা জনপ্রিয় হবে। আজ ২৫ বছর পরেও ‘সেই তুমি’ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের কাছে প্রাসঙ্গিক। বাচ্চু আজ চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর এই সৃষ্টি রয়ে যাবে বাংলাদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায়।
‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি
কীভাবে এত বদলে গেছি এই আমি
ও বুকেরই সব কষ্ট দুহাতে সরিয়ে...’
আজ থেকে ২৫ বছর আগে প্রথম শোনা আইয়ুব বাচ্চুর এই গান আজও নাড়া দিয়ে যায় সব প্রজন্মের শ্রোতাদের। কী এক অদ্ভুত আকর্ষণ, কী অদ্ভুত নস্টালজিয়া এই গানে। বাড়ির স্টেরিওতে ৩৫ টাকার ক্যাসেট দিয়ে যে গান শোনার শুরু, সিডি–এমপিথ্রির যুগ পেরিয়ে আজকের ইউটিউবের কালেও গানটি কতই না প্রাসঙ্গিক। এটি কি বাচ্চুর সংগীতজীবনের সেরা সৃষ্টি?
এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। বাংলাদেশের সংগীতজগতের এই কিংবদন্তি শিল্পী তাঁর জীবনে এত সুর সৃষ্টি করেছেন যে, তাঁর নির্দিষ্ট একটি গান সেরা কি না, তা নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। কিন্তু সবাই একবাক্যে এটি স্বীকার করে নেবেন, ‘সেই তুমি’ গানটি বাংলাদেশের সংগীতজগতেরই এক অনবদ্য ও অমর সৃষ্টি।
১৯৯৩ সালে মালিবাগের একটি বাড়িতে বসে এই গানটি লিখেছিলেন বাচ্চু নিজেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, টানা বসে লিখে শেষ করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোর ফিচার পাতা ‘আনন্দ’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সেই তুমি গান রচনার পেছনের ইতিহাসটা নিজেই বলেছিলেন বাচ্চু, ‘দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই। তবে ১৯৯৩ সালের কোনো একদিন হবে। আমি তখন পশ্চিম মালিবাগে থাকতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক বসাতেই গানটির সৃষ্টি। আমারই লেখা। আমারই সুর করা। আমারই গাওয়া। এক লাইন লিখি আর গিটারে সুর করি। এভাবে গানটা তৈরি হয়। অবশ্য গানটি রেকর্ড করতে অনেক সময় লেগেছে। সংগীত আয়োজনে সময় লেগেছে দুই দিন। কণ্ঠ দিতে বেশি সময় লাগেনি।’
নিছক এক প্রেমের গান নয় এটি; বরং এই গানে উঠে আসে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতাও। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে যখন প্রেমে পড়ে, প্রেম করে, তখন তাদের মধ্যে তৈরি হয় অদ্ভুত এক আকর্ষণবোধ, অদ্ভুত এক দায়বদ্ধতা। কী এক অমোঘ আকর্ষণ কেবলই তাদের কাছে টানে। কিন্তু এই জুটিই যখন নিজেদের প্রেমের পরিণতি টানে, তারা যখন সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেই টান, সেই আবেগটা থাকে না। আবার কোনো কারণে প্রেম পরিণতি না পেলে দুজনের আলাদা জীবনের আকুতিটাও ফুটে ওঠে এই গানের কথায় ও সুরে। বাচ্চু ২৫ বছর আগে ‘সেই তুমি’ গানে এ বাস্তবতাই তুলে এনেছিলেন দারুণভাবে।
এটি বাংলাদেশের সংগীত দুনিয়ার ইতিহাসেরই এক অমর সৃষ্টি—এটা কে না জানে। গানটির জনপ্রিয়তা বাচ্চু নিজেও তাঁর জীবদ্দশায় উপভোগ করে গেছেন। এমন কোনো কনসার্ট ছিল না যেখানে তাঁকে এই গানটি গাইতে হয়নি। এমন কোনো সংগীতবিষয়ক আয়োজন ছিল না, যেখানে বাচ্চুকে এই গান নিয়ে কথা বলতে হয়নি। বাংলাদেশের সংগীতশিল্পে সর্বকালের সেরা গানের তালিকায় ‘সেই তুমি’ ঢুকে যাবে অনায়াসেই, বিনা বিতর্কেই।
‘সেই তুমি’র সৃষ্টি যাঁর হাতে, সেই বাচ্চুর চলে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মেই। অকালেই। কিন্তু তাঁর এই সৃষ্টিগুলো আরও অনেক বছর বাংলাদেশের গানের জগৎকে সমৃদ্ধ করে যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের হৃদয়ে অনুরণন হয়েই থাকবে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানটি।