প্রেমের বিয়ে ছিল না পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবীর। ছিল না রোমাঞ্চ বা লুকোচুরির কোনো নজির। রবিশঙ্কর তখন ১৮ বছরের তরুণ। গুরুর কাছে শিখতে গিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণা তখন ১৩ বছরের কিশোরী। বাড়ির লোকেরাই বেঁধে দিয়েছিলেন এ জুটি।
উদয়শঙ্করের ছোট ভাই রবিন্দ্রশঙ্কর তালিম নিতে গিয়েছিলেন মাইহারে। বছর দুই পর অবশ্য নাম বদলে তিনি হয়ে যান রবিশঙ্কর। সেখানেই অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা রবিশঙ্করের। অন্নপূর্ণাকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘উজ্জ্বল ও দারুণ নজরকাড়া ছিল সে। চোখ দুটো ভারি মিষ্টি আর গায়ের রং আলু ভাইয়ের (ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ) চেয়ে ফরসা।’
বিয়ের ব্যাপারে অন্নপূর্ণা দেবী জানিয়েছিলেন, ‘মাইহারে মা-বাবার সঙ্গে একটা আশ্রমের মতো পরিবেশে বড় হয়েছিলাম আমরা। পণ্ডিতজির প্রতি আকর্ষণ তৈরি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, প্রেম তো দূরের কথা। বাড়ির লোকেদের পছন্দে আমাদের বিয়ে হয়।’ পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর আত্মজীবনী ‘রাগমালা’তে লিখেছেন, ‘আমাদের মধ্যে প্রেম, রোমাঞ্চ বা লুকোচুরির কিছু ছিল না। লোকে অবশ্য সে রকম ভাবত। বিয়ের ব্যাপারে তাঁর মত কী, সেটাও আমি জানতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল তাঁর মত আছে।’
১৯৪১ সালের ১৫ মে সন্ধ্যাবেলা বিয়ে হয়ে যায় অন্নপূর্ণা দেবী ও রবিশঙ্করের। ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় ছেলে শুভেন্দ্র শঙ্কর। জন্মের আট সপ্তাহের মধ্যে একটি জটিল রোগ ধরা পড়ে তার। অন্ত্রের নালিতে ভীষণ ব্যথা হতো তার। মাসখানেকের মধ্যেই অবশ্য সেরে উঠেছিল সে। কিন্তু দেখা দেয় এক নতুন উপসর্গ। সারা রাত কাঁদত সে।
রবিশঙ্করের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, রোজ ১০ ঘণ্টার বেশি সেতার সাধনার পর এই কাঁদুনে শিশুকে নিয়ে সারা রাত জেগে থাকার বিড়ম্বনা থেকেই তাঁদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম টানাপোড়েন শুরু হয়। রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘এ সমস্যার কারণে রাত-জাগা অভ্যাস হয়ে গেল শুভর। এটা এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে চলল। খেয়াল করলাম, অন্নপূর্ণার ব্যক্তিত্ব দিন দিন বদলে যাচ্ছে। আমাদের দুজনেরই শক্তি ক্ষয় হচ্ছিল খুব। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিল আমাদের দুজনেরই। ওই সময়টাতে তুচ্ছ কারণে আমার মেজাজ বিগড়ে যেত। দুজনে একসঙ্গে রেগে উঠতাম। আমি আগে বুঝতে পারিনি, কিন্তু এবার খেয়াল করলাম, ও ঠিক ওর বাবার মেজাজ পেয়েছে। ও আমাকে প্রায়ই বলত, “তুমি শুধু সংগীতের জন্য আমাকে বিয়ে করেছ! আমাকে তুমি ভালোবাসো না! তোমার জন্য তো অন্য রূপসীরা আছে!” কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে খুব হিংসা হতো তার। যখনই আমি অন্য শহর থেকে অনুষ্ঠান করে ফিরতাম, সেখানে আমার কোনো প্রেম আছে বলে আমাকে দুষত সে।’
তাঁদের দাম্পত্য-সংকট চরমে পৌঁছাল যখন অন্নপূর্ণা আবিষ্কার করলেন, নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে রবিশঙ্করের প্রেম চলছে। মর্মাহত অন্নপূর্ণা বোম্বে থেকে ছেলে শুভকে নিয়ে মাইহারে বাবার বাড়িতে চলে যান। চিত্র পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কমলার বিয়ে হওয়ার পর তিনি বোম্বেতে ফিরেছিলেন। কিন্তু রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর কখনো স্বাভাবিক হয়নি। ১৯৬৭ সালে তাঁদের সম্পর্কের ইতি ঘটে। তাঁদের ছেলে শুভ মারা যান ১৯৯২ সালে।
সংসার টিকিয়ে রাখতে জনসমক্ষে পরিবেশনা ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা। এত বড় আত্মত্যাগের পরও তাঁর সংসার টেকেনি। এ প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর অবশ্য ভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন। টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিয়ের পর আমার সঙ্গে বাজাতে অনেক জোরাজুরি করেছি তাঁকে। কিছু অনুষ্ঠানও করেছি আমরা। পরে সে আর একা অনুষ্ঠান করতে চাইত না। সব সময় আমার সঙ্গে বাজাতে চাইত। আমরা যখন আলাদা হয়ে গেলাম, তখন তো অনুষ্ঠান করাই ছেড়ে দিল।’
রবিশঙ্করের ছাত্র ও ‘দ্য নবভারত টাইমস’-এর সংগীত সমালোচক মদন লাল ব্যাস বলেছিলেন, ‘কনসার্ট শেষে লোকজন অন্নপূর্ণাকে ছেঁকে ধরত। পণ্ডিতজির পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। অন্নপূর্ণা ছিলেন অসামান্য এক প্রতিভা। এমনকি তাঁর আপসহীন, ক্ষমাহীন এক গুরুবাবা তাঁকে মূর্তিমতি সরস্বতী বলে ডাকতেন। এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?’
বাবার মতোই আপসহীন ছিলেন অন্নপূর্ণা। গত শতকের সত্তরের দশকে বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিনকে নিয়ে ভারত সফরে গিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। তাঁদের সম্মানে একটি আয়োজন করতে চেয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মেনুহিন আবদার করেছিলেন, অন্নপূর্ণার বাদন শুনতে চান। অনেক অনুরোধের পরও রাজি হননি অন্নপূর্ণা। তবে তিনি যখন রেওয়াজ করবেন, তখন পাশে বসে শোনার সুযোগ পাবেন। সেদিন মেনুহিন যেতে পারেননি। পরিবারের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে দেশে ফিরতে হয়েছিল। সৌভাগ্যবান জর্জ হ্যারিসন, অন্নপূর্ণার পাশে বসে বাদন শুনেছিলেন তিনি।
আজ শনিবার ভোরে পরলোক গমন করেছেন অন্নপূর্ণা দেবী। ম্যানজ ওয়ার্ল্ড